
ত্রিপুরায় ঐতিহাসিক মাতা ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দিরে নতুন রূপ
ত্রিপুরার অন্যতম ঐতিহ্যবাহী ধর্মস্থান মাতা ত্রিপুরেশ্বরী মন্দির নতুন রূপে সেজে উঠেছে প্রসাদ প্রকল্পের আওতায়। মন্দিরের নবনির্মিত রূপের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিরোধী দলগুলিকে আমন্ত্রণ না জানানো ঘিরে শুরু হয়েছে প্রবল রাজনৈতিক বিতর্ক।ত্রিপুরা প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি আশীষ কুমার সাহা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন,“মাতা ত্রিপুরেশ্বরী কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নন। তিনি রাজ্যের প্রতিটি মানুষের। কিন্তু বিজেপি এমনভাবে প্রচার করছে যেন দেবী কেবলমাত্র তাদের দলের। আরও দুঃখজনক যে, প্রধানমন্ত্রীর মতো জাতীয় পর্যায়ের একজন নেতার সরকারি অনুষ্ঠানে বিরোধী দলগুলিকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে।”তিনি অভিযোগ করেন , প্রধানমন্ত্রী শাসক দলের পাশাপাশি বিরোধীদেরও প্রতিনিধি। তাই এই ধরনের সরকারি আয়োজনে সব দলের প্রতিনিধিকে সম্মান জানিয়ে আমন্ত্রণ জানানোই উচিত ছিল।অন্যদিকে প্রদেশ কংগ্রেসের বিধায়ক সুদীপ রায় বর্মনও ফেসবুকে ক্ষোভ উগরে দিয়ে লেখেন,“তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী, কোনো একটি দলের নয়। এমন এক অনুষ্ঠানে বিরোধীদের সম্পূর্ণ বঞ্চিত করা সরকারের অভব্যতার নিদর্শন। ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা কতটা নীচ মানসিকতার পরিচয়, তা আজ জনগণের সামনে স্পষ্ট হয়ে গেল।”তার মতে, মন্দিরের নবরূপ কেবল শাসক দলের গর্ব নয়, বরং গোটা ত্রিপুরার ঐতিহ্যের অংশ। সেখানে বিরোধীদের আমন্ত্রণ না জানানো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অবমাননা।ত্রিপুরার রাজনৈতিক মহলে এখন প্রধান প্রশ্ন—এই উদ্বোধন আসলে সরকারি আয়োজন, নাকি রাজনৈতিক প্রচারের হাতিয়ার?প্রসাদ প্রকল্প কেন্দ্রীয় সরকারের একটি ধর্মীয় পর্যটন উন্নয়ন প্রকল্প। তার আওতায় মাতা ত্রিপুরেশ্বরী মন্দিরকে আধুনিক রূপ দেওয়া হয়। এই প্রকল্পের উদ্বোধন প্রধানমন্ত্রী করলে তা নিঃসন্দেহে একটি রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান। অথচ বিরোধী দলের কোনো প্রতিনিধি সেখানে স্থান না পাওয়ায় সমালোচকরা বলছেন, সরকার বিষয়টিকে একচেটিয়া রাজনৈতিক রূপ দিয়েছে।যদিও বিজেপি শিবির থেকে অনানুষ্ঠানিকভাবে দাবি করা হয়েছে, এটি ছিল সীমিত আমন্ত্রিতদের অনুষ্ঠান। স্থান ও নিরাপত্তাজনিত কারণে সকলকে ডাকা সম্ভব হয়নি। তবে বিরোধীরা সেই যুক্তি মানতে নারাজ। তাদের মতে, যখন প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতি ঘিরে হাজারো মানুষকে জড়ো করা যায়, তখন বিরোধী দলের কয়েকজন নেতাকে জায়গা দেওয়াটা কঠিন কিছু নয়।মাতা ত্রিপুরেশ্বরী মন্দির শুধুমাত্র ত্রিপুরার নয়, সমগ্র পূর্বোত্তরের মানুষের কাছে ভক্তির প্রতীক। হিন্দু ধর্মবিশ্বাসে ৫১ শক্তিপীঠের অন্যতম এই মন্দিরকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর হাজারো ভক্ত সমাগম হয়।রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এমন একটি ঐতিহাসিক ও আধ্যাত্মিক স্থানের উদ্বোধন যদি দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করা হয়, তবে তা মানুষের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে। বিশেষ করে এমন রাজ্যে, যেখানে ধর্ম ও সংস্কৃতির সঙ্গে জনজীবনের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।কংগ্রেসের পাশাপাশি সিপিএমও বিজেপির বিরুদ্ধে একই অভিযোগ তুলতে পারে বলে রাজনৈতিক মহলে জল্পনা। বিরোধীদের অভিযোগ, মন্দিরের উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার চেষ্টা করছে। অথচ জনগণের ঐতিহ্যকে সম্মান জানাতে বিরোধী দলগুলির উপস্থিতি নিশ্চিত করতেই পারল না।স্থানীয়দের একাংশ মনে করেন, রাজনৈতিক লড়াই আলাদা জায়গায় হওয়া উচিত। ধর্ম ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সবার ঐক্য থাকা দরকার। বহু ভক্তই মন্তব্য করেছেন, দেবী মাতা ত্রিপুরেশ্বরী রাজ্যের প্রতিটি মানুষের—সেখানে দলীয় বিভাজন অপ্রাসঙ্গিক।ত্রিপুরায় আগামী দিনে রাজনীতি কোন দিকে মোড় নেবে, তা সময়ই বলবে। তবে মাতা ত্রিপুরেশ্বরী মন্দিরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ঘিরে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তা ইতিমধ্যেই ত্রিপুরার রাজনৈতিক অঙ্গনকে উত্তপ্ত করে তুলেছে।প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে হওয়া এই আধ্যাত্মিক আয়োজন বিরোধীদের কাছে ‘গণতান্ত্রিক সৌজন্যের অভাব’-এর প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে বিজেপির দাবি—এটি কেবল একটি প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতা।কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায়—মন্দির কি কেবলমাত্র এক দলের গর্ব, নাকি গোটা ত্রিপুরার?