
ত্রিপুরায় চাঁদার জুলুমে দোকান ভাঙচুরে আতঙ্কিত ব্যবসায়ীরা
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং রাজ্য পুলিশের মহা-নির্দেশকের কড়া হুঁশিয়ারির পরেও চাঁদার দৌরাত্ম্য কিছুতেই কমছে না। উৎসবের আবহে শারদীয়ার প্রস্তুতি চললেও এরই মধ্যে ব্যবসায়ীদের মাথায় নেমে এসেছে ভয়। অভিযোগ উঠেছে, সেকেরকোট বাজারে একদল দুষ্কৃতিকারী পূজার চাঁদা আদায়ের নামে এক ব্যবসায়ীর দোকান ভাঙচুর ও লুটপাট চালিয়েছে।
আমতলী থানার অন্তর্গত পি এম শ্রী সেকেরকোট দ্বাদশ শ্রেণী বিদ্যালয়ের সংলগ্ন নিউ ক্লাব এ বছর আড়ম্বরপূর্ণভাবে দুর্গাপূজা আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছে। এলাকায় সেরা পূজার খেতাব জিততে এবং বড় বাজেটের আয়োজন করতে গিয়ে ক্লাবের পক্ষ থেকে বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয়। অভিযোগ, এই অর্থ জোগাড়ের জন্যই বাজারের ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছিল।
মঙ্গলবার গভীর রাতে নিউ ক্লাবের কয়েকজন সদস্য স্থানীয় এক ব্যবসায়ীর কাছে ১০ হাজার টাকার চাঁদা দাবি করে। ওই ব্যবসায়ী স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে এত বড় অঙ্কের অর্থ তিনি দিতে পারবেন না। এর পরেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। অভিযোগ, ধারালো দা ও লাঠি নিয়ে বাজারের ভেতরে চারটি দোকান ভাঙচুর করা হয় এবং নগদ টাকা ও পণ্যসামগ্রী লুটপাট চালানো হয়।
ঘটনার সময় বাজার কমিটির অন্যান্য সদস্যদের খবর দেওয়া হলে তারা দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। কিন্তু তারা পৌঁছানোর আগেই দুষ্কৃতিকারীরা পালিয়ে যায়। বাজার কমিটির সম্পাদক ও কর্মকর্তারা পরে আমতলী থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।
এই ঘটনার পর থেকেই ব্যবসায়ীরা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। তাদের দাবি, দুষ্কৃতিকারীদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হোক। একই সঙ্গে নিউ ক্লাবের দুর্গাপূজার আয়োজন এ বছর বন্ধ করার দাবি তুলেছেন ব্যবসায়ী মহল।
রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে কয়েক সপ্তাহ ধরেই স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, দুর্গাপূজার নামে জোর করে চাঁদা আদায় বন্ধ করতে হবে। মুখ্যমন্ত্রী নিজে এবং পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারাও ক্লাব ও সংগঠনগুলোকে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। কিন্তু সেকেরকোট বাজারের এই ঘটনা আবারও দেখিয়ে দিল, স্থানীয় স্তরে এই নির্দেশ মানা হচ্ছে না।
চাঁদাবাজির অভিযোগ নতুন কিছু নয়। প্রায় প্রতি বছরই শারদীয়া উৎসবকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন জায়গা থেকে এমন খবর আসে। বড় বাজেটের প্রতিযোগিতা, শোভাযাত্রার জাঁকজমক, এবং পুরস্কারের লোভে কিছু ক্লাব অনৈতিক উপায়ে অর্থ সংগ্রহের পথ বেছে নেয়। এর ফলে উৎসবের আনন্দ ছায়াচ্ছন্ন হয় আতঙ্কে।
ব্যবসায়ীরা প্রশ্ন তুলছেন, কঠোর হুঁশিয়ারির পরেও প্রশাসন কেন বাস্তবে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না। অভিযোগকারীদের বক্তব্য, থানায় অভিযোগ দায়ের হলেও অপরাধীরা প্রায়ই রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় থেকে যায়। ফলে তারা নির্বিঘ্নে একই কাজ বারবার করতে সাহস পায়।
এমন পরিস্থিতিতে স্থানীয় মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। সাধারণ মানুষ মনে করছেন, পূজা কমিটি বা ক্লাব যদি সত্যিই সমাজের সেবা করতে চায় তবে উচিত সৎ উপায়ে অর্থ সংগ্রহ করা। এলাকাবাসীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে জুলুম চালিয়ে পূজা করার মানেই উৎসবের মূল আত্মাকে কলঙ্কিত করা।
ঘটনার পর বাজার কমিটির সম্পাদক জানান,
“আমরা থানায় লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছি। ব্যবসায়ীরা ভয় পাচ্ছেন, কিন্তু আমরা চাই প্রশাসন দ্রুত ব্যবস্থা নিক। অন্যথায় এভাবে ব্যবসা করা অসম্ভব হয়ে উঠবে।”
“প্রতি বছরই চাঁদার জন্য চাপ আসে, কিন্তু এবার ব্যাপারটা ভয়ংকর রূপ নিল। দোকান ভাঙচুর আর লুটপাটের পর এখন আমাদের মনে হচ্ছে আমরা কেউই নিরাপদ নই।”
দুর্গাপূজা বাংলার অন্যতম বড় উৎসব। এ সময় সারা রাজ্যে আনন্দ-উল্লাস ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু কিছু ক্লাবের অতি উচ্চাভিলাষী আয়োজন সেই আনন্দকে ভয়ের ছায়ায় ঢেকে দিচ্ছে। যারা পূজার নামে সমাজে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। না হলে সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে উৎসব নিয়ে বিরূপ মনোভাব তৈরি হবে।
সেকেরকোট বাজারের ঘটনাটি রাজ্যজুড়ে প্রচলিত একটি বৃহত্তর সমস্যার প্রতিফলন। পূজার নামে জোর করে চাঁদা আদায় কোনোভাবেই সমাজের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। প্রশাসনের কড়া নজরদারি এবং জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ ছাড়া এই প্রবণতা বন্ধ করা সম্ভব নয়।
ব্যবসায়ীদের দাবি একটাই—অভিযুক্তদের দ্রুত গ্রেফতার ও নিউ ক্লাবের এই বছরের পূজার অনুমতি বাতিল। এবার সময়ই বলবে, সরকার ও পুলিশ প্রশাসন এই দাবি কতটা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে এবং উৎসবের আনন্দকে আতঙ্কের ছায়া থেকে রক্ষা করতে কতটা সক্ষম হয়।