
নেপালে রাজনৈতিক অস্থিরতায় আটকা পড়লেন ত্রিপুরার গবেষক স্বপ্নজিত
নেপালে চলতে থাকা রাজনৈতিক অস্থিরতার জেরে গভীর দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন ত্রিপুরার পুরাতন আগরতলার বাসিন্দা খোকন চৌধুরীর পরিবার। তাঁর ছেলে স্বপ্নজিত চৌধুরী সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে যোগ দিতে নেপালে গিয়েছিলেন। সেমিনার শেষ হওয়ার পরদিনই তাঁর কলকাতা ফেরার কথা থাকলেও হঠাৎ উত্তপ্ত হয়ে ওঠা পরিস্থিতির কারণে এখনও দেশে ফিরতে পারেননি তিনি।
পরিবার সূত্রে জানা যায়, গত ৪ সেপ্টেম্বর কলকাতা থেকে গবেষক স্বপ্নজিত নেপালে পাড়ি জমান। বর্তমানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছেন তিনি। গবেষণার অংশ হিসেবেই তাঁকে একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। ৪ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া সেই সেমিনার শেষ হয় ৮ সেপ্টেম্বর। পরের দিন তাঁর কলকাতা ফেরার টিকিটও কাটা ছিল।
কিন্তু ঠিক সেই সময়েই রাজনৈতিক অস্থিরতা চরমে ওঠে নেপালে। বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ, অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ফলে বাতিল হয়ে যায় বহু আন্তর্জাতিক ফ্লাইট। সীমান্তেও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। আর তাতেই আটকা পড়েন স্বপ্নজিত সহ আরও প্রায় চল্লিশজন ভারতীয় ছাত্রছাত্রী।
স্বপ্নজিতের বাবা খোকন চৌধুরী জানিয়েছেন, সেমিনার শেষ হওয়ার পর থেকেই তাঁর ছেলের সঙ্গে যোগাযোগে বিঘ্ন ঘটে। নেটওয়ার্ক পরিষেবা ভেঙে পড়ায় টানা দু’দিন কোনও খবরই পাননি তাঁরা। এই সময়টুকু তাঁদের কাছে ছিল প্রবল উৎকণ্ঠার। অবশেষে পরে কোনওভাবে যোগাযোগ সম্ভব হলেও এখনও অনিশ্চয়তা কাটেনি। ছেলে দেশে নিরাপদে ফিরতে পারবে কি না, সেই ভয়েই দিন কাটছে পরিবারের।
খোকন চৌধুরী বলেন, “ওর ফেরার টিকিট ছিল ৯ সেপ্টেম্বর। কিন্তু হঠাৎ সব কিছু পাল্টে গেল। প্রথম দু’দিন কোনও খবর পাইনি, তখন আমরা ভীষণ চিন্তায় ছিলাম। এখন যোগাযোগ হলেও, যতক্ষণ না ওকে দেশে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে, আমাদের দুশ্চিন্তা কাটবে না।”
আতঙ্কিত পরিবার ইতিমধ্যেই রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারের কাছে সাহায্যের আর্জি জানিয়েছে। তাঁদের দাবি, দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে স্বপ্নজিতসহ নেপালে আটকে থাকা সমস্ত ভারতীয় নাগরিককে দেশে ফিরিয়ে আনা হোক। খোকন চৌধুরীর কথায়, “আমাদের ছেলে তো গবেষণার কাজে গিয়েছিল। ওর কোনও দোষ নেই। সরকারের কাছে হাতজোড় করে আবেদন করছি, যেন ওরা নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারে।”
উল্লেখ্য, গত কয়েকদিন ধরে নেপালে যুবসমাজকে ঘিরে প্রবল অশান্তি দেখা দিয়েছে। রাজধানী কাঠমাণ্ডুসহ বিভিন্ন জায়গায় চলছে বিক্ষোভ, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বিদেশি নাগরিকেরাও ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। নেপালের বিমানবন্দর থেকে একাধিক আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বাতিল হয়েছে। রাস্তাঘাটে চলছে অবরোধ, আর সীমান্তে জারি হয়েছে কড়া নিরাপত্তা।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, রাজনৈতিক টানাপোড়েন থেকে শুরু হওয়া আন্দোলন ধীরে ধীরে হিংসাত্মক রূপ নিয়েছে। তাই দেশ ছাড়ার সুযোগ খুব সীমিত হয়ে পড়েছে বিদেশিদের জন্য।
স্বপ্নজিতের মতো প্রায় চল্লিশজন ভারতীয় ছাত্রছাত্রী একই সেমিনারে যোগ দিতে নেপালে গিয়েছিলেন। তাঁদেরও অবস্থা একই রকম। দেশে ফেরার কথা থাকলেও আকস্মিক পরিস্থিতির কারণে কেউই ফিরতে পারেননি। প্রত্যেকেই হোস্টেলে বা হোটেলে নিরাপত্তার মধ্যে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। তবে পরিস্থিতি কীভাবে বদলাবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা আরও বাড়ছে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রক নেপালের পরিস্থিতির উপর নজর রাখছে। সরকারি সূত্রে জানা গেছে, সেখানে আটকে পড়া ভারতীয়দের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। প্রয়োজনে বিশেষ ফ্লাইটের ব্যবস্থা করার কথাও ভাবা হচ্ছে। তবে সঠিকভাবে কবে নাগাদ তাঁদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
এই পরিস্থিতিতে ত্রিপুরার চৌধুরী পরিবার দুশ্চিন্তার মধ্যে দিন গুনছেন। প্রতিবেশীরাও তাঁদের সঙ্গে আছেন মানসিকভাবে। সকলেই চাইছেন, দ্রুত যেন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে স্বপ্নজিতকে নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনে।
স্বপ্নজিতের মা বলেন, “প্রতিদিন শুধু খবরে তাকিয়ে থাকি। ওকে সুস্থ অবস্থায় ফেরত না পাওয়া পর্যন্ত শান্তি পাব না।”
রাজনৈতিক অস্থিরতা যে শুধু সংশ্লিষ্ট দেশেই নয়, বরং বিদেশিদের জীবনেও প্রভাব ফেলে—নেপালের এই পরিস্থিতি তার বাস্তব প্রমাণ। গবেষণার স্বপ্ন নিয়ে বিদেশ যাত্রা করা স্বপ্নজিতের মতো বহু ছাত্রছাত্রী এখন অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। তাঁদের পরিবারগুলির প্রার্থনা একটাই—যত দ্রুত সম্ভব নিরাপদে বাড়ি ফেরা।