
নতুন প্রযুক্তিতে আলুচাষে রেকর্ড দেশকে পথ দেখাচ্ছে ত্রিপুরা
ত্রিপুরাকে আলু ও আলুবীজ উৎপাদনে সম্পূর্ণ স্বনির্ভর করার লক্ষ্য নিয়ে রাজ্যের কৃষি ও কৃষক কল্যাণ দপ্তর একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় পেরুর ইন্টারন্যাশনাল পটেটো সেন্টার-এর সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। বৃহস্পতিবার আগরতলায় কেন্দ্রটির ডিরেক্টর জেনারেল সাইমন হেক এবং কান্ট্রি ম্যানেজার নিরোজ শর্মার সঙ্গে বৈঠক শেষে এ তথ্য জানান ত্রিপুরার কৃষি ও কৃষক কল্যাণমন্ত্রী রতন লাল নাথ।
মন্ত্রী জানান, বর্তমানে ত্রিপুরায় প্রায় ২৩ হাজার ৭৪৬ জন আলুচাষি সক্রিয়ভাবে চাষাবাদ করছেন। মোট ৪৭ হাজার ৬৩৭ কানি জমি, অর্থাৎ প্রায় ৭,৬২২ হেক্টর জমিতে আলুচাষ হচ্ছে। রাজ্যের বার্ষিক আলু উৎপাদন দাঁড়িয়েছে ১.৪৬ লক্ষ মেট্রিক টন, যেখানে অভ্যন্তরীণ চাহিদা প্রায় ১.৫৫ লক্ষ মেট্রিক টন। এই ঘাটতি পূরণের জন্য এতদিন বাইরের রাজ্য থেকে আলু আমদানি করতে হয়েছে।
আগে হেক্টরপ্রতি উৎপাদন ছিল মাত্র ১৯.১৬ মেট্রিক টন। তবে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে উৎপাদনশীলতা এখন উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে দাঁড়িয়েছে হেক্টরপ্রতি ৬২.৫০ মেট্রিক টন, যা দেশজুড়ে এক রেকর্ড।
ত্রিপুরায় আগে আলুর বীজ সরবরাহ হতো সংরক্ষিত আলু কিংবা পশ্চিমবঙ্গ, পাঞ্জাব ও আগরতলার গোলবাজার থেকে। কিন্তু এ উৎসগুলো অনিশ্চিত এবং গুণগত মানের নিশ্চয়তাও ছিল না। ফলে ফলন কম হতো এবং কৃষকরা লোকসানে পড়তেন।
পরবর্তীতে রাজ্যে ট্রু পটেটো সিডস চালু করা হলেও তা ব্যয়বহুল ছিল এবং দক্ষ শ্রমিক ছাড়া এর উৎপাদন সম্ভব ছিল না। নাগিছড়া গবেষণা কেন্দ্র ছাড়া এই প্রযুক্তি তেমন কার্যকর হয়নি।
এ পরিস্থিতি বদলাতে ২০২২-২৩ অর্থবছর থেকে নতুন পদ্ধতি এপিক্যাল রুটেড কাটিং চালু করে রাজ্য সরকার। এর জন্য কেন্দ্রের রাষ্ট্রীয় কৃষি বীমা যোজনা থেকে ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। এই অর্থ দিয়ে প্রযুক্তি সহায়তা, দক্ষতা বৃদ্ধি, গবেষণা, সার্টিফিকেশন, রপ্তানি সম্ভাবনা এবং আলুচিপস প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
প্রকল্পের আওতায় প্রথম বছরে (২০২৩ সালে) ১০৪ জন কৃষককে বীজ ও চারাগাছ সরবরাহ করা হয়। ২০২৪ সালে সুবিধাভোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪০২ জনে। চলতি বছরে প্রায় ৪,০০০ জন কৃষক এই প্রকল্পের সুবিধা পাবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন মন্ত্রী।
সাইমন হেক বৈঠকে মন্তব্য করেন, তিনি ভারতের অন্য কোথাও এত কার্যকরভাবে আলু উৎপাদনের নজির দেখেননি।
মন্ত্রী রতন লাল নাথ বলেন, “আমাদের লক্ষ্য হলো ধাপে ধাপে কৃষকদের সক্ষমতা বাড়ানো। ২০২৮-২৯ অর্থবছরের মধ্যে ত্রিপুরা আলুবীজে স্বনির্ভর হবে। আর ২০২৯-৩০ সালের মধ্যে সম্পূর্ণভাবে আলু উৎপাদনে আত্মনির্ভর হয়ে উঠবে রাজ্য।”
তিনি আরও যোগ করেন, স্বনির্ভর হওয়ার পর ত্রিপুরা শুধু নিজের চাহিদাই মেটাবে না, বরং বাইরের রাজ্যে রপ্তানি করেও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ত্রিপুরায় আলু উৎপাদনের জন্য মাটি ও আবহাওয়া অত্যন্ত উপযোগী। তবে এখন পর্যন্ত কৃষকরা প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও উন্নতমানের বীজ থেকে বঞ্চিত ছিলেন। ইন্টারন্যাশনাল পটেটো সেন্টার-এর সহায়তা ত্রিপুরার কৃষিকে আধুনিকীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
এছাড়া আলুপ্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে উঠলে কৃষকরা শুধু কাঁচা আলু বিক্রির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবেন না, বরং আলুচিপসসহ নানা ভ্যালু-অ্যাডেড পণ্য উৎপাদনের সুযোগ পাবেন। এর ফলে কৃষকের আয় বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে এবং রাজ্যের অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
আগরতলার এক কৃষক জানান, “আগে আমরা বাইরে থেকে আনা বীজ ব্যবহার করতাম, যা অনেক সময় খারাপ মানের হত। এখন সরকার যে নতুন ব্যবস্থা করেছে, তাতে উৎপাদন অনেক বেড়েছে। আমরা আশা করছি ভবিষ্যতে আর বাইরে থেকে বীজ আনতে হবে না।”
অন্য এক কৃষক বলেন, “যদি আলুচিপস প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র চালু হয়, তাহলে আমাদের ফসলের দাম আরও ভালো পাওয়া যাবে। এতে আমরা তরুণ প্রজন্মকেও কৃষিতে টানতে পারব।”
মন্ত্রী রতন লাল নাথ সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, “ত্রিপুরার কৃষিকে আমরা শুধু খাদ্যনিরাপত্তার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাই না। কৃষিকে আমরা লাভজনক ও টেকসই পেশায় পরিণত করতে চাই। আলু উৎপাদনে স্বনির্ভরতা সেই পথেরই একটি মাইলফলক।”
তিনি আরও বলেন, সরকারের লক্ষ্য হলো প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে কৃষিকে আধুনিকীকরণ করা, যাতে ত্রিপুরা দেশের মধ্যে এক নতুন উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারে।
ত্রিপুরায় আলু উৎপাদনে নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। ২০২২ সাল থেকে শুরু হওয়া এই যাত্রা আগামী কয়েক বছরের মধ্যে রাজ্যকে শুধু স্বনির্ভরই করবে না, বরং সম্ভাব্য রপ্তানিকারক রাজ্য হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। সরকারের পরিকল্পনা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ফলে কৃষকরা এখন আরও আশাবাদী।
যদি এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকে, তবে ২০৩০ সাল নাগাদ ত্রিপুরা শুধু দেশের মানচিত্রেই নয়, বৈশ্বিক আলুবাজারেও শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পারবে।
ত্রিপুরার আরও খবর পেতে
আমাদের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন: https://www.youtube.com/@Tripura-news