
দুর্লভ ফলের চাষে ত্রিপুরা: কৃষকদের আয়ে নতুন সম্ভাবনা
ত্রিপুরার কৃষিক্ষেত্রে অভূতপূর্ব পরিবর্তন আনতে রাজ্যের কৃষি ও কৃষক কল্যাণ দপ্তর একের পর এক নতুন পদক্ষেপ নিচ্ছে। কৃষকদের আয় বৃদ্ধি ও ফসলের বৈচিত্র্য আনার লক্ষ্যেই প্রথমবারের মতো রাজ্যে শুরু হয়েছে মেংগোস্টিন, রামবুটান এবং অ্যাভোকাডো চাষ।
কৃষিমন্ত্রী রতন লাল নাথ জানিয়েছেন, নাগিছড়ার উদ্যান গবেষণা কেন্দ্রে পরীক্ষামূলকভাবে এই বিরল ও বিশেষ ফলগুলির চাষ শুরু হয়েছে। এর পাশাপাশি কিউই, ব্লুবেরি এবং ব্ল্যাকবেরি চাষের পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে।
মন্ত্রী বলেন, “মেংগোস্টিন একটি অত্যন্ত দামী ফল এবং এর বাজারমূল্যও অনেক বেশি। অ্যাভোকাডো আবার স্বাস্থ্যের জন্য বিশেষত ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উপকারী। আগে এই ফলগুলি ত্রিপুরায় চাষ করা হতো না। আমরা কর্ণাটক থেকে দুটি মেংগোস্টিনের চারা এনে রোপণ করেছি। পাশাপাশি রামবুটানের লাল ও হলুদ জাতও চাষ শুরু হয়েছে।”
এই প্রকল্প সফল হলে কৃষকদেরকে এই ফল চাষে উৎসাহিত করা হবে, যা ভবিষ্যতে কৃষকদের আর্থিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বর্তমানে প্রায় ৪৬ হেক্টর জমিতে অ্যাভোকাডো চাষ চলছে। এটি রাজ্যের কৃষকদের জন্য একটি নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। যেহেতু অ্যাভোকাডোর বাজারমূল্য ভালো এবং স্বাস্থ্য সচেতন মানুষের মধ্যে এর চাহিদা বাড়ছে, তাই রাজ্যে এর বাণিজ্যিক উৎপাদন কৃষকদের নতুন আয়ের উৎস হতে পারে।
শুধু বিরল ফল নয়, আলু উৎপাদনেও রাজ্য সরকার বড় পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। বর্তমানে ত্রিপুরায় ২৩,৭৪৬ জন কৃষক মোট ৭,৬২২ হেক্টর জমিতে আলু চাষ করেন। আগে আলু বীজ সংগ্রহ করতে হতো মহারাজগঞ্জ বাজার, পশ্চিমবঙ্গ ও পঞ্জাব থেকে। কিন্তু এখন রাজ্যেই বীজ উৎপাদনের লক্ষ্যে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
২০২৩-২৪ সালে নতুন প্রক্রিয়ায় আলু চাষ শুরু হয়েছে এবং ২০২৪-২৫ সালে ৪১০ জন কৃষককে ১২৮ কানি জমির জন্য বীজ সরবরাহ করা হয়েছে। এবারে লক্ষ্য ২,০৮৭ কানি জমির জন্য বীজ বিতরণ করা, যার মধ্যে ২৫০ কানি জমিতে হবে অর্গানিক আলু চাষ। সরকারের লক্ষ্য ২০২৮-২৯ সালের মধ্যে আলু বীজ উৎপাদনে সম্পূর্ণ স্বনির্ভর হওয়া।

রাজ্যে আলু উৎপাদনে টিস্যু কালচার প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এবছর প্রায় ২,৫১২ কানি জমিতে এআরসি পদ্ধতিতে আলু চাষ করা হবে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে MoVCDNER (ত্রিপুরা অর্গানিক) এবং ত্রিপুরা স্টেট ওয়াটারশেড ম্যানেজমেন্ট এজেন্সি। ফলে ২০২৫-২৬ সালের মধ্যে প্রায় অর্ধেক আলু চাষি এই প্রকল্পের আওতায় আসবে।
জামপুই পাহাড়ের সুপারি চাষিরা বিগত কয়েক বছরে বড় ধরনের ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছেন। সেই ক্ষতি পূরণের লক্ষ্যে কৃষি দপ্তরের পক্ষ থেকে ৪০টি ব্যাটারি চালিত স্প্রে মেশিন, প্রয়োজনীয় কীটনাশক ও অন্যান্য সামগ্রী সরবরাহ করা হয়েছে।
ত্রিপুরার কৃষি খাত এতদিন মূলত ধান, আনারস, সুপারি ও বাঁশজাত দ্রব্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল। তবে নতুন উদ্যোগের ফলে এখন রাজ্যে বৈচিত্র্যময় ফল ও ফসল উৎপাদনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বিশেষত আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদাসম্পন্ন ফল যেমন অ্যাভোকাডো, মেংগোস্টিন ও রামবুটান উৎপাদনের মাধ্যমে কৃষকরা বাড়তি আয় করতে পারবেন।
মন্ত্রী রতন লাল নাথ আশাবাদী যে, এই প্রকল্পগুলি সফল হলে রাজ্যের কৃষকদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হবে এবং কৃষিক্ষেত্রে ত্রিপুরা দেশের অন্যান্য অগ্রণী রাজ্যের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে।
ত্রিপুরার কৃষি দপ্তরের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ শুধু কৃষকদের আয় বৃদ্ধি করবে না, বরং রাজ্যের কৃষি-অর্থনীতিকে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেবে। বিরল ফলের চাষ, আলু উৎপাদনে স্বনির্ভরতা এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার—সব মিলিয়ে কৃষিক্ষেত্রে ত্রিপুরা ধীরে ধীরে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করছে।