
ত্রিপুরায় ‘বিবাহ ও জনজাতি সুবিধা’ ইস্যুতে নতুন বিতর্ক কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন তিপ্রা মথা দলের বিধায়ক রঞ্জিত দেববর্মা
ত্রিপুরার রাজনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয়েছে তুমুল বিতর্ক। কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন তিপ্রা মথা দলের বিধায়ক রঞ্জিত দেববর্মা। তিনি জাতীয় তফসিলি উপজাতি কমিশনের কাছে এক চিঠি পাঠিয়ে দাবি করেছেন— জনজাতি যুবতীরা যদি অ-জনজাতি যুবকের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, তবে তাঁদের সমস্ত সরকারি এসটি (তফসিলি উপজাতি) সুবিধা অবিলম্বে বাতিল করা হোক।
এই নজিরবিহীন দাবিকে ঘিরে ইতিমধ্যেই ত্রিপুরা জুড়ে শোরগোল পড়েছে। রাজনৈতিক মহল থেকে শুরু করে সমাজবিজ্ঞানী এবং সাধারণ মানুষ— সকলে নিজেদের মতামত দিচ্ছেন।
রঞ্জিত দেববর্মার অভিযোগ, রাজ্যে বহু অ-জনজাতি যুবক ইচ্ছাকৃতভাবে এসটি যুবতীদের বিয়ে করছেন, মূলত আর্থিক সুবিধা ভোগের উদ্দেশ্যে।
চিঠিতে তিনি লিখেছেন—
বিবাহের পর ভিন্ন জাতির বররা তাঁদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যেমন পেট্রোল পাম্প, গ্যাস এজেন্সি, রেশন দোকান ইত্যাদি স্ত্রীর নামে স্থানান্তর করছেন।
এর ফলে তাঁরা সরকারি কর ফাঁকি দিতে পারছেন এবং বিভিন্ন ভর্তুকি ভোগ করছেন।
উপজাতি স্ত্রীর নামে জমি ক্রয় করে ভূমি কর এড়ানো হচ্ছে।
এমনকি টিটিএএডিসি (ত্রিপুরা ট্রাইবাল এরিয়া অটোনমাস ডিস্ট্রিক কাউন্সিল) অঞ্চলে জমি কিনে রাবার বাগান, ইটভাটা চালানো হচ্ছে।
বিধায়কের দাবি, এভাবে প্রকৃত জনজাতি পরিবারগুলি তাঁদের ন্যায্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। পাশাপাশি সরকারও বিপুল পরিমাণ বৈধ কর রাজস্ব হারাচ্ছে।
বিধায়কের এই চিঠি প্রকাশ্যে আসতেই এক নতুন বিতর্ক জন্ম নিয়েছে। মূল প্রশ্ন—
একজন জনজাতি যুবতী যদি ভালোবেসে বা নিজের ইচ্ছায় অ-জনজাতি যুবককে বিয়ে করেন, তবে কি তাঁর সাংবিধানিক অধিকার বাতিল হয়ে যাবে?
সমাজকর্মী মহলের মতে, এই দাবি নারীর স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত অধিকারের পরিপন্থী। কারণ ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিকের নিজস্ব পছন্দ অনুযায়ী বিবাহের অধিকার রয়েছে।
আইন বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন—
এই প্রস্তাব কার্যকর হলে তা নারীর মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করবে।
বিবাহ একটি ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত; তার সঙ্গে সরকারি সুবিধা জুড়ে দেওয়া সংবিধানবিরোধী হতে পারে।
এতে সমাজে বিভাজন বাড়তে পারে এবং ত্রিপুরার সম্প্রীতির পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
অন্যদিকে, রঞ্জিত দেববর্মার সমর্থকরা বলছেন—
সরকারের দেওয়া এসটি সুবিধাগুলি মূলত পিছিয়ে পড়া উপজাতি সম্প্রদায়ের উন্নয়নের জন্য।
যদি এই সুবিধা অ-জনজাতি পরিবারগুলির হাতে চলে যায়, তবে প্রকৃত সুবিধাভোগীরা বঞ্চিত হবেন।
কর ফাঁকি রোধ এবং জনজাতি সমাজের অধিকার রক্ষার স্বার্থে কঠোর পদক্ষেপ প্রয়োজন।
ত্রিপুরার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের তরফে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে।
কিছু দল মনে করছে, এটি জনজাতি সমাজকে রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে।
অন্যরা বলছেন, এই ইস্যু কেবল জনজাতি ও অ-জনজাতি সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ তৈরি করবে, যা রাজ্যের শান্তি ও ঐক্যের পরিপন্থী।
তথ্যবিশ্লেষকদের মতে, এই প্রস্তাব কার্যকর হলে ত্রিপুরার সামাজিক কাঠামোতে বড়সড় প্রভাব পড়তে পারে।
জনজাতি মহিলাদের উপর এক ধরনের সামাজিক চাপ তৈরি হবে।
আন্তঃজাতি বিবাহ নিরুৎসাহিত হবে, যা সংবিধান প্রদত্ত স্বাধীনতার বিরুদ্ধে।
ত্রিপুরার বহু পরিবার বিভক্তির মুখে পড়তে পারে।
সংবিধান বনাম প্রথা
এই বিতর্কে উঠে আসছে দুটি দিক—
প্রত্যেক নাগরিকের স্বাধীনভাবে বিবাহ করার অধিকার রয়েছে। কোনো জাতি, ধর্ম বা সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে এই অধিকার খর্ব করা যায় না।
সরকারি সুবিধাগুলি মূলত দুর্বল সম্প্রদায়ের উন্নয়নের জন্য। যদি তা অন্যরা দখল করে নেন, তবে প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়।
বিধায়ক রঞ্জিত দেববর্মার চিঠি এখন জাতীয় তফসিলি উপজাতি কমিশনের টেবিলে। কমিশন কী সিদ্ধান্ত নেয়, তা নিয়ে সবার নজর সেখানে।
একদিকে রয়েছে জনজাতি সমাজের ন্যায্য অধিকার রক্ষার প্রশ্ন, অন্যদিকে নারীর ব্যক্তিস্বাধীনতা ও সাংবিধানিক অধিকার। এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
ত্রিপুরায় ‘বিবাহ ও জনজাতি সুবিধা’ ইস্যু এখন তীব্র আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। রাজনীতির মঞ্চ থেকে শুরু করে কফি-হাউসের আড্ডা— সর্বত্রই চলছে তর্ক-বিতর্ক। এই বিতর্ক শেষ পর্যন্ত কোন দিকে গড়াবে, তা সময়ই বলবে। তবে একথা নিশ্চিত— এ ইস্যু ত্রিপুরার রাজনীতি ও সমাজে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে চলেছে