
জেল থেকে সরকার চালানো কি গ্রহণযোগ্য? গয়া থেকে প্রশ্ন তুললেন মোদী
লোকসভায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সম্প্রতি পেশ করেছেন বহুল আলোচিত ১৩০তম সংবিধান সংশোধনী বিল। আর এই বিলকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে তীব্র রাজনৈতিক তোলপাড়। বিরোধীরা শুরু থেকেই এর বিরোধিতা করলেও, এবার গয়া থেকে সরাসরি মন্তব্য করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সরকারি কর্মচারীদের দৃষ্টান্ত টেনে এনে তিনি প্রশ্ন তুললেন— “একজন সাধারণ কর্মচারী সামান্য সময়ের জন্য জেলে গেলে চাকরি হারান, অথচ একজন মন্ত্রী কিংবা মুখ্যমন্ত্রী কারাগার থেকেই সরকার চালাতে পারেন— এটা কতটা গ্রহণযোগ্য?”
গয়ার জনসভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন
“যদি কোনও সরকারি কর্মচারী মাত্র ৫০ ঘণ্টা জেলে কাটান, তাঁর চাকরি চলে যায়। তিনি চালক, কেরানি বা পিয়ন যেই হোন না কেন, নিয়ম সবার জন্য একই। কিন্তু রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। একজন মন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী কিংবা প্রধানমন্ত্রীও জেল থেকে সরকার চালিয়ে যেতে পারেন! এটা কি স্বচ্ছ রাজনীতির লক্ষণ?”
তিনি আরও যোগ করেন, সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, কারাগার থেকেই ফাইলে সই করা হয়েছে, এমনকি সরকারি নির্দেশনাও জারি করা হয়েছে। “নেতারাই যদি এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, তবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করব কীভাবে?”— প্রশ্ন তোলেন মোদী।
যদিও নাম উল্লেখ করেননি, রাজনৈতিক মহল মনে করছে প্রধানমন্ত্রী স্পষ্টতই খোঁচা দিয়েছেন দিল্লির প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবালকে। মনে করিয়ে দেওয়া যায়, আবগারি দুর্নীতি মামলায় কেজরীবাল ইডি-র হাতে গ্রেফতার হওয়ার পরও মুখ্যমন্ত্রী পদে বহাল ছিলেন এবং জেল থেকেই প্রশাসনিক কাজ চালিয়েছিলেন। ছ’মাস কারাভোগের পর সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে জামিনে মুক্ত হয়ে তিনি পদত্যাগ করেন এবং দায়িত্ব অর্পণ করেন অতীশী মার্লেনাকে।
নতুন বিল পেশ হওয়ার পর থেকেই বিরোধী শিবির তা নিয়ে সরব। তাদের অভিযোগ, এই সংশোধনী আইনে রূপ নিলে কেন্দ্রীয় সরকার বিরোধী দলগুলিকে দমন করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবে ইডি, সিবিআইয়ের মতো সংস্থাগুলিকে।
লোকসভায় বিল পেশের দিনও বিরোধীদের তুমুল বিক্ষোভের কারণে অধিবেশন মুলতুবি করতে হয়। এমনকি, সংসদ কক্ষে বিলের কাগজ ছিঁড়ে ফেলেন কয়েকজন বিরোধী সাংসদ।
পর্যবেক্ষকদের মতে, এই বিলকে আইন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা সহজ কাজ নয়। কারণ, সংবিধান সংশোধনীর জন্য সংসদের উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োজন। ফলে বিরোধী দলগুলির ঐক্যবদ্ধ অবস্থান এই প্রক্রিয়াকে কঠিন করে তুলতে পারে।
বিহারে শিগগিরই বিধানসভা নির্বাচন। তার আগেই গয়ায় জনসভা করে কার্যত বিরোধীদের উপর চাপ বাড়ালেন প্রধানমন্ত্রী। মোদীর বার্তা স্পষ্ট— এনডিএ সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আপসহীন এবং এই লড়াইয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজেও দায়বদ্ধ। রাজনৈতিক মহল মনে করছে, নির্বাচনের আগে দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানকে সামনে রেখে বিজেপি জনমত গড়ে তুলতে চাইছে।
রাজনৈতিক বক্তৃতার আগে প্রধানমন্ত্রী যোগ দিয়েছিলেন গয়ার একটি সরকারি অনুষ্ঠানে। সেখানে একাধিক উন্নয়নমূলক প্রকল্পের উদ্বোধন করেন তিনি। এরপর পাটনা হয়ে আসেন পশ্চিমবঙ্গে। কলকাতায় তিনি একাধিক মেট্রো পরিষেবার আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন—
ইয়েলো লাইন: নোয়াপাড়া থেকে জয়হিন্দ বিমানবন্দর পর্যন্ত অংশ।
অরেঞ্জ লাইন: নিউ গড়িয়া-বিমানবন্দর রুটের হেমন্ত মুখোপাধ্যায় স্টেশন থেকে বেলেঘাটা।
উদ্বোধনের পর প্রধানমন্ত্রী নিজেও মেট্রোতে যাত্রা করেন, যশোহর রোড থেকে জয়হিন্দ বিমানবন্দর পর্যন্ত। পরে আবার মেট্রোতে ফিরে গিয়ে সড়কপথে দমদম সেন্ট্রাল জেল ময়দানে একটি রাজনৈতিক সভায় যোগ দেন।
১৩০তম সংবিধান সংশোধনী বিল নিয়ে দেশজুড়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তার কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদীর এই বক্তব্য নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সরকারি কর্মচারী ও রাজনৈতিক নেতাদের জন্য ভিন্ন নিয়ম নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি একদিকে বিরোধীদের আক্রমণ করেছেন, অন্যদিকে নিজের সরকারকে দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছেন।
তবে এই বিল সংসদের উভয় কক্ষে পাস হবে কিনা, সেটাই এখন রাজনৈতিক মহলের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। আর সেই উত্তর নির্ভর করছে বিরোধী ঐক্য এবং সরকারের রাজনৈতিক কৌশলের উপর।