
নেপালের ইতিহাসে প্রথম নারী অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কারকি
নেপাল আবারও এক অস্থির রাজনৈতিক অধ্যায়ের মধ্যে প্রবেশ করল। চলমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, তীব্র বিক্ষোভ ও সংসদ ভেঙে দেওয়ার দাবির প্রেক্ষাপটে দেশটির রাষ্ট্রপতি রাম চন্দ্র পৌডেল শপথ গ্রহণ করালেন নেপালের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় রচনা করা একজন নারীকে। তিনি আর কেউ নন, দেশটির প্রথম নারী প্রধান বিচারপতি এবং সদ্য নিয়োগ পাওয়া অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী সুশীলা কারকি।
এই পদক্ষেপ শুধু নেপালের রাজনীতিতে নয়, দক্ষিণ এশিয়ার নারী নেতৃত্বের ইতিহাসেও এক অনন্য মাইলফলক হয়ে থাকবে।
রাষ্ট্রপতির আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা সুরেশ চন্দ্র চালিসে জানান, সংবিধানের চেতনা মেনে এবং চলমান অস্থিরতা নিরসনের লক্ষ্যে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন শীর্ষ রাজনৈতিক নেতা, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও কূটনৈতিক প্রতিনিধিরা।
‘জেন-জি আন্দোলনকারীরা’ দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছিলেন যে সংসদ ভেঙে দিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করতে হবে। তাদের চাপ, সড়ক বিক্ষোভ এবং অনলাইন ভোটাভুটির ফলাফলে সুশীলা কারকিকেই “জনমতের প্রতীক” হিসেবে দেখা হচ্ছিল। এই আন্দোলনের মধ্যেই রাষ্ট্রপতি তাকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্বে আনলেন।
রাষ্ট্রপতির আরেক উপদেষ্টা কিরণ পোখারেল বলেছেন, “রাষ্ট্রপতি মন্ত্রী পরিষদের সাথে পরামর্শ করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবেন। জরুরি অবস্থা জারি এবং নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার বিষয়েও আলোচনা চলছে।”
নেপালের সাম্প্রতিক আন্দোলনে প্রাণ হারিয়েছে অন্তত ১৯ জন। আহত হয়েছেন শতাধিক। বিক্ষোভের দ্বিতীয় দিনে সুশীলা কারকি নিজেই বানেশ্বরের বিক্ষোভস্থলে যান এবং আহতদের হাসপাতালে গিয়ে খোঁজখবর নেন। এই পদক্ষেপ আন্দোলনকারীদের কাছে তাকে আরও গ্রহণযোগ্য করে তোলে।
বিক্ষোভকারীরা মূলত সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন করে নির্বাচনের দাবি তুলেছিলেন। একই সঙ্গে তারা চাইছিলেন যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নেতৃত্ব দেবেন এমন কেউ, যিনি সরাসরি সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নন এবং যিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন। কারকির অতীত কর্মকাণ্ডই তাকে এই ভূমিকায় এগিয়ে দিয়েছে।
১৯৫২ সালে নেপালের বিরাটনগরে জন্মগ্রহণ করেন সুশীলা কারকি। নেপালি কংগ্রেসের প্রভাবশালী কৈরালা পরিবারের ঘনিষ্ঠ পরিবেশে বড় হয়েছেন তিনি। ভারতের বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় এবং নেপালের ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন।
আইনপেশায় প্রবেশের সিদ্ধান্ত নেওয়া তার সময়ের জন্য ছিল বেশ অস্বাভাবিক। নারী আইনজীবীর সংখ্যা তখন হাতে গোনা। তবুও তিনি দৃঢ় সংকল্প নিয়ে দীর্ঘ তিন দশক ধরে বিরাটনগর ও ধরণ অঞ্চলে আইন চর্চা করেন।
পরবর্তীতে প্রধান বিচারপতি রাম প্রসাদ শ্রেষ্ঠা তার যোগ্যতা দেখে তাকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদে সুপারিশ করেন। এই নিয়োগ ছিল তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বাঁক।
পারিবারিক জীবনে কারকির স্বামী ছিলেন নেপালি কংগ্রেসের তৎকালীন নেতা দুর্গা সুবেদী। নিজের যাত্রায় স্বামীর সহায়তা ও সততাকে তিনি বরাবরই মূল্যবান বলে উল্লেখ করেছেন।
২০১৬ সালে তিনি নেপালের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন। তার মেয়াদ ছিল মাত্র ১১ মাস, কিন্তু এই স্বল্প সময়ে তাকে বহু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়।
নতুন সংবিধান কার্যকর না হওয়া
সুপ্রিম কোর্টে মামলার জট বৃদ্ধি
বিচারকের সংকট
প্রশাসনিক স্বচ্ছতা রক্ষার চাপ
এই সবকিছুর মধ্যেও তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেন। বিশেষত সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী জেপি গুপ্তাকে দুর্নীতির মামলায় দোষী সাব্যস্ত করার রায় তার নামকে আলোচনায় আনে।
সুশীলা কারকি প্রায়শই দুর্নীতির মামলা শুনানি করতেন। একটি আলোচিত ঘটনায় তিনি কমিশন ফর দ্য ইনভেস্টিগেশন অফ অ্যাবিউজ অফ অথরিটি (CIAA)-এর প্রধান লোকমান সিং কার্কির বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা পুনরুজ্জীবিত করার নির্দেশ দেন।
এই সিদ্ধান্ত নেপালে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। অনেকেই মনে করেন, এই এক পদক্ষেপই প্রমাণ করে কারকি সত্যিকার অর্থে দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ ও নির্ভীক অবস্থান নিয়েছিলেন।
প্রধান বিচারপতি হিসেবে থাকাকালীন তার বিরুদ্ধে সংসদে অভিশংসন প্রস্তাব দাখিল করা হয়। অভিযোগ ছিল তিনি বিচারক নিয়োগে নিরপেক্ষ থাকেননি এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সুযোগ দিয়েছেন।
যদিও সুপ্রিম কোর্ট পরে এই অভিশংসনকে অকার্যকর ঘোষণা করে। সমালোচকরা বলেন, তিনি সবসময়ই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার চেয়ে রাজনৈতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করেছেন। তবে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক প্রতীকী কণ্ঠস্বর হিসেবেই থেকে গেছেন।
অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নতুন চ্যালেঞ্জ
বর্তমানে নেপালের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক অস্থির পরিস্থিতি বিরাজ করছে। অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে সুশীলা কারকিকে যে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হবে তা হলো—
সংসদ ভেঙে দেওয়া ও নতুন নির্বাচন আয়োজন
জরুরি অবস্থা জারি করা বা না করার সিদ্ধান্ত
বিক্ষোভকারীদের আস্থা ধরে রাখা
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা আনা
আন্তর্জাতিক মহলে নেপালের ভাবমূর্তি বজায় রাখা
দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার অতীত অবস্থান এবং অদম্য মনোবল তাকে কিছুটা এগিয়ে রাখলেও পরিস্থিতি মোটেও সহজ নয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই মুহূর্তে কারকির নিয়োগ জনগণের কাছে আশার আলো হতে পারে। তবে একই সঙ্গে চাপও বিরাট। কারণ, তিনি হঠাৎ করেই রাজনীতির মূল অঙ্গনে প্রবেশ করেছেন।
সমর্থকরা বলছেন, তিনি দুর্নীতিবিরোধী বার্তার প্রতীক। সমালোচকরা মনে করছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্ব দেওয়া তার পূর্বেকার অবস্থানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
৭৩ বছর বয়সী সুশীলা কারকির জন্য এই মুহূর্ত একটি ঐতিহাসিক সুযোগ। তিনি নেপালের প্রথম নারী প্রধান বিচারপতি হওয়ার পর আবারও প্রথম নারী অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হলেন।
এই সিদ্ধান্ত কেবল প্রতীকী নয়, বরং একটি স্পষ্ট বার্তাও বটে—সংকটময় সময়ে নেপালের জনগণ ও নেতৃত্ব নারীদেরও আস্থার আসনে বসাতে সক্ষম।
তবে সামনে রয়েছে বহু অনিশ্চয়তা, রাজনৈতিক চাপ ও সমঝোতার প্রয়োজন। ইতিহাস বলবে, সুশীলা কারকি এই মুহূর্তকে নেপালের ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রের নতুন অধ্যায়ে রূপ দিতে পারবেন কিনা।
📌 দেখুন আজকের ত্রিপুরার বাছাই করা খবর
👇 ভিডিও লিঙ্কে ক্লিক করুন: