
স্ত্রীর হৃদয় হাতে নিয়ে রাস্তায় ঘুরাঘুরি করছে স্বামী। স্ত্রীর খুনে গ্রেপ্তার রমেশ রায়
ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে সময়ে সময়ে ঘটে চলেছে নৃশংস হত্যার ঘটনা। শুক্রবার সকালে উত্তরবঙ্গের ময়নাগুড়ি ও হুগলির কোন্নগরে পরপর দুটি ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ড ঘটল, যা আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। স্বামী-স্ত্রীর কলহ যে কতটা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে, তারই করুণ প্রমাণ মিলল এদিন।
ময়নাগুড়ির ভয়াবহ দৃশ্য: স্ত্রীর হৃৎপিণ্ড হাতে ঘুরল স্বামী
শুক্রবার সকালে ময়নাগুড়ির ব্যাংকান্দি এলাকায় যা ঘটল, তা রীতিমতো সিনেমার দৃশ্যকেও হার মানায়। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, রমেশ রায় নামে এক ব্যক্তি ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাঁর স্ত্রী দীপালি রায়কে (৪৫) খুন করেন। শুধু খুনই নয়, স্ত্রীর দেহ থেকে হৃৎপিণ্ড কেটে নিয়ে রাস্তায় ঘুরতে দেখা যায় তাঁকে।
এলাকার মানুষ প্রথমে চোখকপালে তোলেন। কেউ কেউ আতঙ্কে বাড়ির দরজা বন্ধ করে দেন। স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান নীলিমা রায় জানান, সকাল আটটা নাগাদ খবর পান তিনি। গ্রামের এক যুবক ফোন করে জানান, রমেশ একটি ব্যাগে স্ত্রীর দেহের টুকরো ভরে নিয়ে এসে সেটি খুলে দেখিয়েছে। পরিবারের লোকজন ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেন।
এরপরই গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে রক্তাক্ত রমেশের কীর্তির খবর। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, তাঁকে এলাকায় রক্তমাখা হাতে ঘুরে বেড়াতে দেখা গিয়েছে। বাড়ির ভেতরে গিয়ে লোকজন খুঁজে পান রক্তে ভেজা বিছানা, চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শরীরের অংশবিশেষ।
খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই পালিয়ে যায় রমেশ। তবে তল্লাশি চালিয়ে শেষ পর্যন্ত শিঙিমারি এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে ময়নাগুড়ি থানার পুলিশ। গ্রেপ্তারের সময়ও তাঁর হাতে ছিল স্ত্রীর হৃৎপিণ্ড। পুলিশ উদ্ধার করেছে হত্যার অস্ত্রও।
প্রাথমিকভাবে পুলিশের ধারণা, হয় রমেশ মানসিকভাবে অসুস্থ, নয়তো স্ত্রীর প্রতি চরম ঘৃণাই তাকে এমন নৃশংস ঘটনায় ঠেলে দিয়েছে। দেহাংশ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে এবং ঘটনার পূর্ণ তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ।
হুগলির কোন্নগরে ভিন্ন কাহিনি: স্ত্রীকে খুন করে দিদিকে প্রণাম, তারপর থানায় আত্মসমর্পণ
এদিনই হুগলির কোন্নগর মাস্টারপাড়ায় ঘটে আরেক চাঞ্চল্যকর ঘটনা। প্রাক্তন পৌরকর্মী অশোক চট্টোপাধ্যায় তাঁর স্ত্রী সবিতা চট্টোপাধ্যায়কে (৫৮) খুন করেন। এরপর বাড়িতে মৃতদেহ ফেলে রেখে দরজায় তালা দিয়ে দিদির কাছে গিয়ে প্রণাম করেন তিনি।
পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, অশোক ও সবিতার মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই অশান্তি চলছিল। অশোক কর্মহীন ছিলেন এবং বাজারে ধার দেনা করেছিলেন। আর্থিক টানাপোড়েন ও প্রতিদিনকার ঝগড়াঝাঁটিই তাঁদের সম্পর্ককে চরমে পৌঁছে দেয়। ঘটনার দিনও দু’জনের মধ্যে তুমুল অশান্তি হয়।
অশোক বাড়ি ছেড়ে দিদির কাছে গিয়ে জানান, তিনি স্ত্রীকে খুন করেছেন। ছোড়দি ও অন্যান্য আত্মীয়দের কাছে খবর পৌঁছতেই পুলিশে যোগাযোগ করা হয়। উত্তরপাড়া থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে তালা ভেঙে উদ্ধার করে মহিলার মৃতদেহ। প্রাথমিক অনুমান, শ্বাসরোধ করেই খুন করা হয়েছে তাঁকে।
পরবর্তীতে অশোক নিজেই থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। বর্তমানে পুলিশ তাঁকে হেফাজতে নিয়ে ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে।
একদিনে দুটি ভিন্ন জেলার ভিন্ন ঘটনা হলেও, দুটির মধ্যে একটি বড় মিল রয়েছে—স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের টানাপোড়েন। বিশেষজ্ঞদের মতে, পারিবারিক অশান্তি, মানসিক অসুস্থতা ও আর্থিক সংকট প্রায়ই চরম সহিংসতার দিকে ঠেলে দেয় মানুষকে।
ময়নাগুড়ির ঘটনাটি নিছক খুন নয়, বরং তা এক ধরনের মানসিক বিকারগ্রস্ততার ইঙ্গিত দেয়। অপরদিকে কোন্নগরের ঘটনা দীর্ঘদিনের দাম্পত্য কলহের পরিণতি।
ময়নাগুড়ি ও হুগলির এই দুটি ঘটনাই প্রমাণ করে, গার্হস্থ্য অশান্তি অনেক সময় কেবল পারিবারিক বিষয় থাকে না, তা সমাজকেও কাঁপিয়ে তোলে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, দু’টি ক্ষেত্রেই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে খুনের মামলা রুজু হয়েছে এবং তদন্ত চলছে।
তবে সাধারণ মানুষের মনে এখন প্রশ্ন—এমন ভয়ঙ্কর ঘটনা কিভাবে বারবার ঘটছে? পরিবারে অশান্তি যদি অতি স্বাভাবিক বিষয় হয়, তবে তার সমাধান কি কেবল আদালত বা পুলিশের দ্বারস্থ হওয়া? নাকি সমাজের ভেতরে আগে থেকে কোনও নজরদারি বা মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রয়োজন?
একদিনে দুটি জেলা, দুটি ভিন্ন পরিবার, কিন্তু একই পরিণতি—স্ত্রীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পরিবারের ভাঙন। ময়নাগুড়ি হোক বা হুগলি, এই ঘটনাগুলি শুধু সংবাদপত্রের শিরোনাম নয়, বরং এক গভীর সংকেত। সম্পর্কের টানাপোড়েনকে উপেক্ষা করলে, তা যে কতটা ভয়ঙ্কর দিকে যেতে পারে, তার বাস্তব উদাহরণ মিলল শুক্রবার সকালে।