জুবিন গর্গের মৃত্যু ঘিরে উত্তাল অসম ! দুর্ঘটনা নাকি পরিকল্পিত হত্যা?
অসম ও উত্তর পূর্ব ভারতের প্রিয় সন্তান, ভারতের জনপ্রিয় গায়ক জুবিন গর্গের মৃত্যুর পর কেটে গেছে দুই সপ্তাহ। কিন্তু এই সময়ের মধ্যেই তাঁর মৃত্যুকে ঘিরে জল্পনা, আবেগ ও প্রশ্ন আরও গভীর হয়েছে। সিঙ্গাপুরে তাঁর আকস্মিক মৃত্যু এখন আর শুধু একটি ট্র্যাজেডি নয়—এটি পরিণত হয়েছে রহস্য, সন্দেহ ও আইনি তদন্তের কেন্দ্রে।
১৯ সেপ্টেম্বর, সিঙ্গাপুরে এক উৎসব উপলক্ষে সফরে থাকা অবস্থায় প্রয়াত হন জুবিন গর্গ। তাঁর মৃত্যুতে অসম থেকে শুরু করে গোটা দেশজুড়ে শোকের ঢেউ নেমে আসে। সংগীতপ্রেমীরা এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না যে তাঁদের প্রিয় রকস্টার আর নেই।
অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা রবিবার বলেন, “জুবিনের মৃত্যুর তদন্ত সুষ্ঠুভাবে চলছে। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট আপাতত প্রকাশ করা হবে না, কারণ তা আদালতের কার্যক্রমে প্রভাব ফেলতে পারে। তবে যে কেউ রিপোর্ট দেখতে চাইলে অনুমতি নিয়ে সিআইডি অফিসে গিয়ে তা পড়তে পারবেন।”
জুবিন গর্গের মরদেহের দুটি ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে—প্রথমটি সিঙ্গাপুরে, দ্বিতীয়টি অসমের গুয়াহাটি মেডিকেল কলেজে। দুটি রিপোর্টই তাঁর স্ত্রী গরিমা গর্গের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। পরে তিনি তদন্তে সহায়তার স্বার্থে রিপোর্টগুলি সিআইডির কাছে ফেরত দেন।
অসম সরকার ইতিমধ্যেই গঠন করেছে একটি বিশেষ তদন্ত দল (SIT) যার তত্ত্বাবধানে কাজ করছে ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (CID)। পাশাপাশি,গুয়াহাটি হাইকোর্ট* ও এই ঘটনার ওপর একটি বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করেছে। দুই দিক থেকেই চলছে তদন্ত, কিন্তু উত্তর এখনও অধরা।
সবচেয়ে আলোচিত দিকটি হলো—বিষপ্রয়োগের অভিযোগ। গায়কের এক সহযোগী শেখর জ্যোতি গোস্বামী দাবি করেছেন, জুবিনকে সিঙ্গাপুরে “ইচ্ছাকৃতভাবে বিষ দেওয়া হয়েছিল”।
মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত শর্মা জানান, “ময়নাতদন্তে সংগৃহীত ভিসেরার রিপোর্ট ১০ অক্টোবরের মধ্যে পাওয়া যাবে। ওইদিনই স্পষ্ট হবে জুবিনকে সত্যিই বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল কিনা।”
তিনি আরও বলেন, “বিষপ্রয়োগের অভিযোগটি পুলিশ নয়, বরং অভিযুক্তেরই দাবি। তদন্তেই প্রমাণিত হবে তাঁর বক্তব্যে কতটা সত্যতা আছে।”
হিমন্ত শর্মা স্পষ্ট করেছেন, “পুলিশের কাজ হলো প্রত্যেক প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য নথিভুক্ত করা—কেউ ইতিবাচক বলুক, কেউ নেতিবাচক। কিন্তু এগুলো পুলিশের মত নয়; এগুলো শুধু সাক্ষীর জবানবন্দি।”
তাঁর মতে, এখনো পর্যন্ত পুলিশের পক্ষ থেকে কোনও নিশ্চিত বক্তব্য দেওয়া হয়নি। তদন্ত চলছে একাধিক দিক থেকে।
সরকারি নথি অনুযায়ী, জুবিন গর্গের সিঙ্গাপুর সফরে উপস্থিত ছিলেন তাঁর ব্যান্ডমেট শেখর জ্যোতি গোস্বামী ম্যানেজার সিদ্ধার্থ শর্মা এবং অনুষ্ঠানের আয়োজক শ্যামকানু মহন্ত।
গোস্বামীর অভিযোগ অনুযায়ী, সিঙ্গাপুর ভেন্যুটি বেছে নেওয়া হয়েছিল ষড়যন্ত্রমূলকভাবে—যাতে মৃত্যুর পর তদন্ত জটিল হয়ে ওঠে। তাঁর দাবি, “জুবিনকে ইচ্ছাকৃতভাবে বিষ দেওয়া হয়েছিল এবং ঘটনাটিকে দুর্ঘটনা বলে উপস্থাপন করার চেষ্টা চলছে।”
এই মামলায় ইতিমধ্যেই চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে—সিদ্ধার্থ শর্মা, শ্যামকানু মহন্ত, শেখর জ্যোতি গোস্বামী এবং সহ-গায়ক অমৃতপ্রভা মহন্ত।
শনিবার রাতে অসম পুলিশ সার্ভিসের (APS) অফিসার **সন্দীপন গরগ যিনি জুবিনের সঙ্গে সিঙ্গাপুর সফরে গিয়েছিলেন, তিনিও গুয়াহাটিতে সিআইডির সামনে হাজির হন। তাঁর জবানবন্দিও তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এই মৃত্যুকে ঘিরে এখনো অনেক প্রশ্নের উত্তর মেলেনি—
- জুবিন গর্গের মৃত্যু কি প্রকৃতপক্ষে দুর্ঘটনা, নাকি পরিকল্পিত হত্যা?
- শেখর জ্যোতি গোস্বামীর অভিযোগের পেছনে কতটা সত্যতা আছে?
- এবং, ভিসেরা রিপোর্ট কি সব সন্দেহের অবসান ঘটাবে, নাকি আরও নতুন প্রশ্ন তুলবে?
তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি জানিয়েছে, তারা প্রত্যক্ষদর্শী, মেডিক্যাল টিম ও সংশ্লিষ্ট সকলের বয়ান রেকর্ড করছে। প্রতিটি রিপোর্ট আদালতের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
অসমের রাস্তাঘাটে, সোশ্যাল মিডিয়ায় এবং সাংস্কৃতিক মহলে এখন একটাই সুর“জুবিনের জন্য ন্যায় চাই”
গায়কের মৃত্যুর সুষ্ঠু তদন্তের দাবিতে বিভিন্ন সংগীতপ্রেমী ও নাগরিক সংগঠন ইতিমধ্যেই প্রতিবাদ মিছিল করেছে।
অসমের বহু জেলায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে প্রার্থনা সভা ও শ্রদ্ধানুষ্ঠান। তাঁর গাওয়া জনপ্রিয় গান “Ya Ali”, “Moi Eti Zazabor” বা “mayabini”—এখন আরও করুণভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে মানুষের মুখে মুখে।
জুবিন গর্গ শুধু একজন গায়ক ছিলেন না তিনি ছিলেন অসমীয়া সংস্কৃতির প্রাণ। সব দিকেই তাঁর ছোঁয়া ছিল অনন্য। তাঁর কণ্ঠস্বর প্রজন্মের পর প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।
অসমের মুখ্যমন্ত্রী তাঁর মৃত্যুতে বলেছেন, “জুবিন গর্গ শুধু অসমের নয়, গোটা ভারতের নয়নের মণি। তাঁর মতো শিল্পীর অভাব সহজে পূরণ করা সম্ভব নয়।”
তদন্ত সংস্থা এখন অপেক্ষা করছে ১০ অক্টোবরের ভিসেরা রিপোর্টের জন্য। সেটিই হবে এই মামলার প্রথম বড় মোড়।
যদি রিপোর্টে বিষের উপস্থিতি পাওয়া যায়, তবে তদন্ত নতুন দিকে মোড় নেবে—সম্ভবত খুনের মামলা হিসেবে। আর যদি বিষের প্রমাণ না মেলে, তবে তদন্ত কেন্দ্রিত হবে মৃত্যুর পরিস্থিতিগত দিকগুলোতে।
মুখ্যমন্ত্রী আবারও আহ্বান জানিয়েছেন, “যে যেখানেই থাকুন, যদি কেউ ওইদিনের ঘটনার সাক্ষী হন বা কোনও তথ্য জানেন, দয়া করে তদন্তে সহযোগিতা করুন। এখন দেখার বিষয় এই ঘটনার পেছনে লুকিয়ে থাকা রহস্য বের হয় কি না।