
ইন্দো-বাংলা ত্রিপুরা সীমান্তে পাচার চক্রের সন্দেহে বিএসএফের জালে ধরা পড়ল বিজিবি জওয়ান
ইন্দো-বাংলা ত্রিপুরা সীমান্ত আবারও উত্তপ্ত। পাচার বাণিজ্যের আঁতুরঘর হিসেবে পরিচিত এই সীমান্তে এবার ধরা পড়লেন এক বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) জওয়ান। অভিযোগ, পাচারকারীদের সহযোগিতা করতে গিয়ে তিনি বেআইনিভাবে ভারতের ভূখণ্ডে প্রবেশ করেন। সীমান্তের কঠোর নজরদারির মধ্যেই তাঁকে আটক করতে সক্ষম হয়েছে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ।
সূত্রের খবর অনুযায়ী, ঘটনার সময় বৃহস্পতিবার দুপুর দেড়টা নাগাদ। বাংলাদেশ সীমান্তের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার দিক থেকে বিজিবি-র ওই সদস্য অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত অবস্থায় ভারতের দিকে অগ্রসর হন। তিনি জিরো পয়েন্ট পেরিয়ে প্রায় ১০০ মিটার ভারতের অভ্যন্তরে চলে আসেন।
এই সময় সিপাহীজলার কামথানা বিওপি-র ৪৯ নং ব্যাটেলিয়ানের বিএসএফ জওয়ানরা তাঁকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে থামার নির্দেশ দেন। কিন্তু অভিযুক্ত বিজিবি সদস্য থেমে যাওয়ার পরিবর্তে দ্রুত বাংলাদেশমুখী পালানোর চেষ্টা করেন। তখনই বিএসএফের সদস্যরা তৎপর হয়ে ওঠেন এবং শেষমেশ ভারতের ভূখণ্ডেই তাঁকে আটক করতে সক্ষম হন।
প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। ধারণা করা হচ্ছে, সীমান্তপারের ওই বিজিবি সদস্য কেবল অসাবধানতাবশত ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ করেননি, বরং পাচারকারীদের সরাসরি সহযোগিতা করতেই এ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।
অভিযোগ রয়েছে, সীমান্তের এই অঞ্চলটি দীর্ঘদিন ধরেই গরু, মাদকদ্রব্য এবং অন্যান্য অবৈধ সামগ্রীর পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ভারতীয় গোয়েন্দা সূত্র দাবি করছে, ধৃত বিজিবি জওয়ান এই চক্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত থাকতে পারেন।
সীমান্তে বিএসএফের কড়া নজরদারির কারণেই তাঁর এই অবৈধ কার্যকলাপ ধরা পড়ে বলে জানানো হয়েছে। বিএসএফের এক সিনিয়র অফিসার বলেন,
“ভারতীয় সীমান্তে কোনো ধরনের অনুপ্রবেশকে আমরা বরদাস্ত করব না। বিশেষ করে যখন সেটি একজন বিদেশি আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যের দ্বারা সংঘটিত হয়। আমাদের জওয়ানরা পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করেছেন।”
তিনি আরও জানান, ঘটনার পর আটক বিজিবি সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়েছে এবং বিষয়টি কেন্দ্রীয় প্রশাসন পর্যন্ত পৌঁছেছে।
ত্রিপুরা রাজ্যের প্রশাসনিক মহল স্বভাবতই উদ্বিগ্ন। সীমান্তে এমন ঘটনা খুবই সংবেদনশীল হিসেবে ধরা হচ্ছে। রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ইতিমধ্যেই আরও সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ত্রিপুরা সরকারের এক মুখপাত্র জানান,
“এই ঘটনা প্রমাণ করে পাচার চক্র সীমান্তে কতটা গভীরভাবে শেকড় গেড়ে বসেছে। রাজ্য প্রশাসন বিএসএফ ও অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে পরিস্থিতির উপর সর্বোচ্চ নজর রাখছে।”
ইন্দো-বাংলা সীমান্ত, বিশেষ করে ত্রিপুরা অঞ্চলে, বহু বছর ধরেই পাচার ব্যবসার জন্য কুখ্যাত। গরু, ফেনসিডিল, ইয়াবা, এমনকি মানবপাচার—সবই এখানে ঘটে থাকে। অনেক সময় স্থানীয় দালাল থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক চক্র সক্রিয় থাকে এই ব্যবসায়।
তবে, সীমান্তরক্ষী বাহিনীর উপস্থিতি বেড়ে যাওয়ার পর থেকে পাচারের রাস্তাগুলি ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠেছে। কিন্তু সম্প্রতি পাচারকারীরা নতুন কৌশল হিসেবে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে বলেই মনে করা হচ্ছে। বিজিবি জওয়ানের ধরা পড়া সেই আশঙ্কাকেই আরও জোরদার করছে।
ঘটনাটি নিছক একটি অনুপ্রবেশ না হয়ে কূটনৈতিক জটিলতায় পরিণত হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের সীমান্ত সহযোগিতা রয়েছে। দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী নিয়মিত ফ্ল্যাগ মিটিং, যৌথ টহল ইত্যাদির মাধ্যমে সম্পর্ক বজায় রাখে।
কিন্তু এবার যখন সরাসরি এক বিজিবি সদস্য পাচারকাজে যুক্ত থাকার অভিযোগে ধরা পড়েছেন, তখন পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে সম্পর্কের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
ঘটনার পর বিজিবি-র সঙ্গে কূটনৈতিক স্তরে যোগাযোগ শুরু করেছে বিএসএফ। প্রথা অনুযায়ী, দুই বাহিনীর মধ্যে ফ্ল্যাগ মিটিং হতে পারে। তবে, ভারতীয় প্রশাসন চাইছে ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হোক এবং প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটিত হোক।
তদন্তকারীরা খতিয়ে দেখছেন—
ওই বিজিবি জওয়ান এককভাবে পাচারচক্রে যুক্ত ছিলেন, নাকি বৃহত্তর কোনো নেটওয়ার্কের অংশ?
তাঁর সঙ্গে স্থানীয় দালাল বা পাচারকারীদের যোগাযোগ কীভাবে স্থাপিত হয়েছিল?
এই ধরনের ঘটনা আর কোথাও ঘটছে কি না।
সীমান্তবাসীর উদ্বেগ
ঘটনার পর সীমান্তের স্থানীয় বাসিন্দারাও আতঙ্কিত। এক গ্রামবাসী বলেন,
“সীমান্তে প্রতিদিনই কিছু না কিছু পাচারের ঘটনা ঘটে। আমরা অনেক সময় ভয়ে কিছু বলি না। কিন্তু যদি সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যরাই এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন, তাহলে আমাদের নিরাপত্তা কোথায়?”
এই মন্তব্য স্পষ্ট করে যে সীমান্তে সাধারণ মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে।
ত্রিপুরার সীমান্তে বিজিবি সদস্যের ধরা পড়া নিছক একটি ঘটনাই নয়, বরং এটি সীমান্তপারের জটিল বাস্তবতা ও অবৈধ বাণিজ্যের গভীর শিকড়কে প্রকাশ করছে। একদিকে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী তাদের সতর্কতা ও তৎপরতার প্রমাণ দিয়েছে, অন্যদিকে এই ঘটনা দুই দেশের সম্পর্কেও নতুন প্রশ্ন তুলেছে।
আগামী দিনে বিএসএফ নজরদারি আরও কড়া করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাশাপাশি রাজ্য প্রশাসনও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো— সীমান্তের অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা পাচার চক্রকে আদৌ কি সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করা সম্ভব?