
ত্রিপুরার বড়লুঙ্গার রক্তাক্ত রাত
ত্রিপুরার তেলিয়ামুড়ার প্রত্যন্ত গ্রাম বড়লুঙ্গা—যেখানে শান্ত, নিরীহ বাঙালি কৃষিজীবীরা বছরের পর বছর নিশ্চিন্তে বসবাস করছিলেন। কিন্তু ১৯৯৯ সালের ১৪ আগস্ট রাতটা সেই গ্রামের ইতিহাসে চিরকাল অন্ধকার হয়ে রয়ে গেছে। স্বাধীনতা দিবসের আগের সন্ধ্যায়, রাত সাড়ে নয়টা নাগাদ, এনএলএফটির (ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট অফ ত্রিপুরা) বিশ্বমোহন গোষ্ঠীর সশস্ত্র জঙ্গিরা গ্রামে ঢুকে পড়ে। জলপাই রঙের পোশাক, হাতে একে সিরিজের রাইফেল—এভাবেই তারা মুহূর্তে গ্রামটিকে রক্তের স্রোতে ভাসিয়ে দেয়।
জঙ্গিরা প্রথমে চারপাশে এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়ে আতঙ্ক ছড়ায়। তারপর ঘরে ঘরে ঢুকে একে একে ১৬ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে গুলি করে হত্যা করে। নিহতদের মধ্যে ছিলেন শিশু, বৃদ্ধ, নারী—কেউ রক্ষা পাননি। মাত্র কয়েক মিনিটে চারটি পরিবার সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। গ্রামবাসীরা ভয়ে ছুটে এলে সামনে পড়ে শুধু রক্তাক্ত লাশ আর ধ্বংসস্তূপ।
আজও নিহতদের পরিবারের সদস্যরা সেই রাতের বিভীষিকা ভুলতে পারেননি। ভাঙা মাটির ঘরের দেয়ালে এখনও রয়েছে বুলেটের দাগ, যা স্মরণ করিয়ে দেয় সেই রক্তাক্ত অধ্যায়কে। অনেক পরিবার তখন গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়, কিন্তু কেউই যথাযথ পুনর্বাসন পাননি।
ঘটনার পর তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার প্রতিটি পরিবারকে মাত্র ২৫ হাজার টাকা সহায়তা দেয়, যা শোকের সাগরে এক বিন্দু সান্ত্বনাও আনতে পারেনি। এর বাইরে কোনো দীর্ঘমেয়াদি সহায়তা বা নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়নি।
বিদ্রুপের বিষয়, যে বিশ্বমোহন ও তার জঙ্গিগোষ্ঠী এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল, তাদের জন্য পরবর্তীতে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ২৫০ কোটি টাকার আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করে এবং রাজ্য সরকারও সেই ত্রিপাক্ষিক চুক্তিতে সায় দেয়। নিহতদের পরিবার আজও প্রশ্ন তোলে—“বাঙালির রক্তের দাম কি এতই তুচ্ছ?”
বড়লুঙ্গার রাত শুধু এক গ্রামের নয়, গোটা ত্রিপুরার বাঙালি সম্প্রদায়ের জন্য এক স্থায়ী ক্ষতচিহ্ন। স্বাধীনতার প্রাক্কালে ঘটে যাওয়া এই হত্যাযজ্ঞ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, শত্রু সবসময় সীমান্তের ওপারে থাকে না—কখনও সে আসে পাশের জঙ্গল থেকে, নিজের দেশের ভেতর থেকেও।