
আগরতলা পুরনিগমের কোষাগার থেকে ১৬ কোটি টাকা উধাও
আগরতলা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন (এএমসি)-এর কোষাগার থেকে প্রায় ১৬ কোটি টাকা রহস্যজনকভাবে উধাও হয়ে যাওয়ায় ত্রিপুরা জুড়ে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মহলে প্রবল চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। রাজ্যের ইতিহাসে অন্যতম বড় এই আর্থিক কেলেঙ্কারি সামনে আসতেই একদিকে যেমন প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, অন্যদিকে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে।
সূত্রের খবর অনুযায়ী, এএমসি কমিশনার ডি.কে. চাকমা ব্যয়ের হিসাব মেলাতে গিয়ে গুরুতর অসামঞ্জস্য লক্ষ্য করেন। আর্থিক খতিয়ান যাচাই করতে গিয়ে তিনি দেখতে পান, প্রায় ১৬ কোটি টাকার বিশাল অঙ্কের অর্থ ব্যাঙ্ক থেকে তোলা হয়েছে, অথচ এর কোনো অনুমোদিত নথি পুরনিগমের রেকর্ডে নেই। তৎক্ষণাৎ তিনি বিষয়টি ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষকে জানান। সেখানেই প্রকাশ্যে আসে এই চাঞ্চল্যকর প্রতারণার কাহিনি।
কমিশনারের অভিযোগে বলা হয়েছে, চারটি ভুয়ো চেক ব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ অর্থ তুলে নেওয়া হয়েছে। আরও চমকপ্রদ বিষয় হল—চেকগুলিতে কমিশনার ডি.কে. চাকমা এবং প্রাক্তন ইন-চার্জ কমিশনার পি. সামাদের জাল স্বাক্ষর ব্যবহার করা হয়েছে। উল্লেখ্য, নিয়মিত কমিশনার ড. শৈলেশ কুমার যাদব কিছু সময় দায়িত্বে না থাকায় সামাদকে অস্থায়ীভাবে কমিশনার হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছিল। প্রতারণাকারীরা তাঁদের নাম ও স্বাক্ষরের অপব্যবহার করে রাজধানীর ইউকো ব্যাঙ্কের প্রধান শাখায় চেক জমা দেয়।
এএমসি-র তরফে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের করার পর ইউকো ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ একটি এফআইআর দায়ের করেছে। পুলিশ ইতিমধ্যে তদন্ত শুরু করেছে। যদিও বিরোধীদের অভিযোগ, ব্যাঙ্কের একাংশ কর্মী এবং পুরনিগমের কয়েকজন অসাধু কর্মচারীর যোগসাজশ ছাড়া এত বড় অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে, আগরতলার মেয়র দীপক মজুমদার জানিয়েছেন, গোটা ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত চলছে এবং ব্যাঙ্ক এই অর্থ ফেরত দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে। তবে তিনি ব্যাঙ্কের বিরুদ্ধে গুরুতর গাফিলতির অভিযোগ তুলেছেন।
ঘটনার পর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছেন সুব্রত বণিক নামের এক ত্রিপুরা সিভিল সার্ভিস গ্রেড-টু অফিসার। তিনি এএমসি-র ড্রয়িং অ্যান্ড ডিসবার্সিং অফিসার (ডিডিও) হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে তাঁর চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তাঁকে আরও ছয় মাসের জন্য দায়িত্বে বহাল রাখা হয়। পরবর্তীতে সাধারণ প্রশাসন (জিএ), পি অ্যান্ড টি বিভাগে তাঁর নিয়োগ সংক্রান্ত ফাইল ঝুলে যায়। সেই সময়েই বিস্তারিত অডিট শুরু হলে ১৬ কোটি টাকার প্রতারণা প্রকাশ্যে আসে।
বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির অভিযোগ, এই প্রতারণা শুধুমাত্র কয়েকজন দুষ্কৃতীর কাজ নয়, বরং প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতিরই স্পষ্ট প্রমাণ। তাঁদের দাবি, উচ্চপর্যায়ের স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করে পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখা হোক। বিরোধীদের বক্তব্য—সরকার এবং পুরনিগম যদি পরিষ্কারভাবে নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত না করে, তবে সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকা এভাবে লুটপাট হতে থাকবে।
আগরতলার মেয়র দীপক মজুমদার অবশ্য পুরনিগমের সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, ‘‘পুরো ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। তদন্তের মাধ্যমে আসল দোষীদের চিহ্নিত করা হবে। ব্যাঙ্কের তরফ থেকে ইতিমধ্যে অর্থ ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি এসেছে। তবে ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। তারা যদি স্বাভাবিক দায়িত্ব পালন করত, তাহলে এই প্রতারণা সম্ভব হত না।
প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, প্রতারকরা চারটি জাল চেক তৈরি করে, যেখানে কমিশনারদের স্বাক্ষর হুবহু নকল করা হয়। ব্যাংকের ভেতরে থাকা গাফিলতির সুযোগ নিয়েই সেই চেকের মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের অর্থ তুলে নেওয়া হয়। পুলিশের এক কর্তা জানিয়েছেন, “চেকগুলির কালি, কাগজ ও প্রিন্ট নিয়ে ফরেনসিক পরীক্ষা শুরু হয়েছে। শীঘ্রই পরিষ্কার হবে, কীভাবে এই জালিয়াতি সংঘটিত হয়েছে।”
ইতিমধ্যেই পুলিশ বেশ কয়েকজন ব্যাঙ্ক কর্মী ও পুরনিগমের কর্মচারীর বয়ান রেকর্ড করেছে। সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। পাশাপাশি অডিট টিমও আলাদা করে সব আর্থিক নথি খতিয়ে দেখছে। তদন্তকারী সংস্থার মতে, পুরো ঘটনার পেছনে একটি সুসংগঠিত চক্র কাজ করেছে বলে প্রাথমিকভাবে অনুমান করা হচ্ছে।
রাজধানী আগরতলা ছাড়াও গোটা রাজ্যে সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। নাগরিকদের বক্তব্য, শহরের উন্নয়নের জন্য যে অর্থ ব্যয় হওয়ার কথা ছিল, তা যদি এভাবে উধাও হয়ে যায়, তবে সাধারণ মানুষই শেষ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। রাজনৈতিক মহলে যেমন আলোড়ন তৈরি হয়েছে, তেমনি সাধারণ মানুষও স্বচ্ছ ও কড়া তদন্তের দাবি জানাচ্ছেন।
ত্রিপুরায় এর আগে এমন বড়সড় আর্থিক প্রতারণার ঘটনা খুব বেশি প্রকাশ্যে আসেনি। তাই আগরতলা পুরনিগমের কোষাগার থেকে ১৬ কোটি টাকা উধাও হয়ে যাওয়ার খবর নিঃসন্দেহে রাজ্যের প্রশাসনিক কাঠামোর উপর এক বড় প্রশ্নচিহ্ন এঁকেছে। এখন দেখার বিষয়—তদন্ত কতটা স্বচ্ছভাবে এগোয় এবং দোষীদের বিরুদ্ধে কত দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আপাতত গোটা রাজ্যের নজর পুলিশের তদন্ত ও ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের পরবর্তী পদক্ষেপের দিকে।