আবারও দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে ঝামেলা চীন, আমেরিকার ও ভারতবর্ষের মধ্যে
নিজস্ব প্রতিনিধি : ইন্ডিয়া : প্রিয়াংকা বনিক : ১ সেপ্টেম্বর
ভারত, আমেরিকা, চীন, ব্রিটেন, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, জাপান সহ বিশ্বের সব ক্ষমতাশালী দেশের নৌবহরই এখানে মজুত আছে। চীনের সাথে এই অঞ্চলে ভারত ও আমেরিকার রীতিমতো স্নায়ুযুদ্ধের মত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে কে এই এলাকা প্রভাব বিস্তার করবে সেই নিয়ে।
ভারত মহাসাগর সহ ইন্দো প্যাসিফিকে চীন বহুদিন ধরেই নিজের ক্ষমতা বাড়াচ্ছে যার কারনে অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ভারত ও আমেরিকা কোয়াড নামে যৌথভাবে একটি সংগঠন তৈরি করেছে যার কাজ চীনকে আটকানো। এছাড়া অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা ও ব্রিটেনের মধ্যে আকুস নামে একটি জোট তৈরি হয়েছে যার উদ্দেশ্য চীনের বিরুদ্ধে অস্ট্রেলিয়াকে পরমানু সাবমেরিন দেওয়া। কিন্ত সম্প্রতি এখানে এমন দুটি ঘটনা হয়েছে যার কারনে এই অঞ্চলে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রথমত এই অঞ্চলের একটি ছোট দেশ সোলোমোন আইল্যান্ড চীনের সাথে নিরাপত্তা চুক্তি করেছে এবং দ্বিতীয়ত চীনের চাপে সোলোমন আইল্যান্ড দেশে বিদেশী যুদ্ধজাহাজ বিশেষ করে আমেরিকা, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়ার জাহাজ আসার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, যা এই এলাকায় নতুন করে ভূ- রাজনৈতিক সংকট তৈরি করছে। ২০১০ অবধি চীন ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে রীতিমতো বানিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। কিন্তু ২০১৭ আসতে আসতে দুই দেশের সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে।
গত এক দশকে অন্তত এমন ২৪ টি দেশের সাথে তাইওয়ানের কুটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে তাইওয়ানের চীনের কারনে। মূলত চীনের ব্যাপক বিনিয়োগের কারনে দেশগুলো তাইওয়ান থেকে সরে এসেছে, এদেরই মধ্যে একটি দেশ হচ্ছে এই সোলোমন আইল্যান্ড। ২০১৯ সাল পর্যন্ত তাইওয়ানের সাথে দেশটির ভাল সম্পর্ক ছিল। কিন্তু ২০১৯ সালে দেশটিতে সরকার পরিবর্তন হয় এবং প্রধানমন্ত্রী হয় চীন ঘনিষ্ঠ মানাসে সোগাভারে। প্রধানমন্ত্রী হয়েই তিনি তাইওয়ানকে বাদ দিয়ে চীনের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করেন। গত মার্চে চীন ও সোলোমন আইল্যান্ডের মধ্যে নিরাপত্তা চুক্তি সাক্ষরিত। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই চুক্তির যাবতীয় তথ্য আগেই সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ হয়ে গিয়েছিল যাতে দেখা যাচ্ছে চীন সোলোমন দ্বীপে তার নাগরিক, বিনিয়োগ রক্ষা করার জন্য সেনাবাহিনী পাঠাবে এবং চীনের যুদ্ধজাহজ সোলোমন দ্বীপে থাকবে।
অর্থাৎ চীন ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে একটি মিলিটারি ও নেভাল বেস হিসাবে ব্যাবহার করবে সোলোমন আইল্যান্ডকে। সোলমন আইল্যান্ডের রাজনৈতিক পরিকাঠামো সম্পর্কেও একটু জানা দরকার।
সোলোমন দ্বীপে ১৯৯৮ সলে একটি সশস্ত্র বিপ্লব হয়েছিল মূলত বাইরের দ্বীপের লোকেদের মূল ভূভাগে বসতি স্থাপনকে কেন্দ্র করে। মূলত মালেটা দ্বীপের সাথো মূল সোলোমন ভূভাগের ঝামেলা এটা। ২০০০ সালে টাউনসেভিলি শান্তি চুক্তিও হয় উভয় পক্ষের মধ্যে। কিন্তু তার পরেও প্রায় ঝামেলা হতেই থাকত। যার জন্য ২০০৩ সালে অস্ট্রেলিয়া তার শান্তিরক্ষা বাহিনী পাঠিয়েছিল এখানে। ২০১৭ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার সেনা ছিল এখানে। প্রায় ৭০০০ সেনা পাঠিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া এখানে। নভেম্বর, ২০২১ এ এখানে আবারও বিদ্রোহ শুরু হয়। তখন মানাসে সোগাভারের অনুরোধে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও ফিজি তার সেনা পাঠিয়েছিল এখানে এবং দেশটিতে শান্তি স্থাপন করা হয়। কিন্তু করোনা মহামারীর কারনে দেশটির অর্থনীতি পুরো স্তব্ধ হয়ে যায় কারন সলোমন দ্বীপের প্রধান অর্থনৈতিক ভিত্তি হচ্ছে পর্যটন শিল্প যা করোনা কালে বন্ধ ছিল। এরই সুবিধা নেয় চীন। কোন দেশে বিদ্রোহ, অর্থনৈতিক সংকট চললে তার সুবিধা নেয় চীন, সেসব দেশে চীন একটি দলকে সমর্থন করে নিজের প্রভাব বাড়ায়।
সোলোমোন আইল্যান্ডেও তাই হয় কারন চীনের অর্থনীতি খুবই শক্তিশালী। চীনের সাথে চুক্তির পর অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা তীব্র প্রতিক্রিয়া দিয়েছিল কিন্তু মানাসে সোগাভারে জানায় অস্ট্রেলিয়া তাদের ভাল বন্ধু কিন্তু সোলোমন আইল্যান্ড নিরাপত্তার জন্য চীনের সাথে চুক্তি করেছে। আসলে এতদিন দক্ষিন ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ারই আধিপত্য ছিল কিন্তু এবার চীনও সেখানে প্রবেশ করছে যেটা অস্ট্রেলিয়ার জন্য খুবই ঝামেলার কারন। শুধু সোলোমন আইল্যান্ডই নয় অস্ট্রেলিয়ার আশেপাশে ভানুয়াতুতেও চীন নেভাল বেস তৈরি করছে এবং পাপুয়া নিউগিনিতে নতুন শহরই তৈরি করছে যার জন্য দক্ষিন ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকা চীনের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন।
সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার ক্যানাবেরাতে অবস্থিত আমেরিকান অ্যামবেসি হঠাৎ জানায় সোলোমন আইল্যান্ড আমেরিকার জাহাজকে তাদের দেশে আসতে নিষেধ করেছে। স্বাভাবিক ভাবেই এই বিষয় নিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতি উত্তাল হয়ে ওঠে কারন আমেরিকার মতন সুপার পাওয়ারকে না করার ক্ষমতা খুব কম দেশেরই আছে। অস্ট্রেলিয়ার খুব কাছেই এই সোলোমন দ্বীপ, আমেরিকা ও ইংল্যান্ড থেকে জাহাজ এলে এই দ্বীপে দাঁড়াত। কিন্তু সোলোমন দ্বীপের প্রধানমন্ত্রী মানাসে সোগাভারে বক্তব্যের পর থেকেই বিতর্ক তৈরি হয়। তিনি জানানা তারা আপাতত কোন বিদেশী জাহাজকেই সোলোমন দ্বীপে আসতে দেবে না।
এবার মনে হতে পারে চীন কেন সোলোমন আইল্যান্ডকেই বেছে নিল? চীন সোলোমন দ্বীপকে তার বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআই প্রজেক্টের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। চীন এর নাম দিয়েছে এয়ার সিল্ক রোড। কারন এশিয়া থেকে মধ্য ও দক্ষিন আমেরিকায় বানিজ্য করবার জন্য সোলোমন দ্বীপে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভূ-রাজনৈতিক অনেক বিশেষজ্ঞদের মতে এশিয়ার অনেল দেশ শ্রীলঙ্কা ও আফ্রিকাতে চীনের বিনিয়োগের বিরুদ্ধে গন প্রতিবাদ হচ্ছে সেজন্য চীন বিনিয়োগের জন্য অন্য অঞ্চল খুঁজছে সেজন্য সোলোমন দ্বীপে চীন প্রভাব বাড়াচ্ছে।
Post Comment