
ত্রিপুরায় অশান্তির ছায়া বাঙালিদের উচ্ছেদ ও বিভাজনের অভিযোগ
ত্রিপুরার রাজনৈতিক অঙ্গন আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। “আমরা বাঙালি” দলের পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয়েছে যে, পরিকল্পিতভাবে রাজ্যে নতুন করে অশান্তি ছড়ানোর ষড়যন্ত্র চলছে। এক সাংবাদিক সম্মেলনে দলের রাজ্য সচিব গৌরাঙ্গ রুদ্র পাল দাবি করেন, বিশেষতঃ এডিসি (স্বশাসিত জেলা পরিষদ) এলাকার বাঙালিদের উচ্ছেদ করার জন্য চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে এবং মথার দলের নেতারা এতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন।
গৌরাঙ্গ রুদ্র পাল জানান, গত কয়েক মাস ধরেই বিশ্রামগঞ্জ, গন্ডাছড়া ও আমবাসার কলমছড়া অঞ্চলের দীর্ঘদিনের বাসিন্দা গরিব বাঙালিদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এদের অনেকে ৪০-৫০ বছর ধরে ওইসব এলাকায় বসবাস করছেন। অভিযোগ অনুযায়ী, মথার দলের প্রভাবশালী নেতারা চাইছেন এই এলাকাগুলি থেকে বাঙালিদের উচ্ছেদ করতে।
তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, “সরকার সব জেনেও গদি রক্ষার স্বার্থে একেবারে নীরব ভূমিকা পালন করছে। জনজাতি সম্প্রদায়ের কিছু অংশ সরকারি জমি জবরদখল করছে অথচ প্রশাসন চোখ বন্ধ করে আছে। অন্য রাজনৈতিক দলগুলিও জনজাতি ভোট হারানোর ভয়ে এই ইস্যুতে মুখ খুলছে না।”
“আমরা বাঙালি” দলের দাবি, কিছু অঞ্চলে প্রকাশ্যে “গো ব্যাক বাঙালি” স্লোগান দেওয়া হচ্ছে। এর পেছনে শাসক দল এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের নীরব সমর্থন আছে বলেও অভিযোগ তাঁদের। গৌরাঙ্গ রুদ্র পাল বলেন, “যখন রাজ্যে বারবার বাঙালিরা আক্রান্ত হচ্ছে, তখন সব রাজনৈতিক দল ভোটের অঙ্ক কষতে ব্যস্ত, কিন্তু প্রতিবাদ করার সাহস দেখাচ্ছে কেবল আমরাই।”
দলের পক্ষ থেকে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও টেনে আনা হয়। রাজ্য সচিব দাবি করেন, একসময় ত্রিপুরার রাজারা বাংলার সমতল ও পার্বত্য অঞ্চল শাসন করতেন এবং দীর্ঘকাল বাঙালিরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন। ত্রিপুরার রাজারা বাঙালি সংস্কৃতি, শিক্ষা ও সামাজিক ঐতিহ্যকে স্বীকৃতি দিয়ে বাংলা ভাষাকে রাজভাষার মর্যাদা দিয়েছিলেন। এমনকি রাজপরিবারের সদস্যরাও নিজেদের বাঙালি পরিচয়ে গর্ববোধ করতেন।
তিনি আরও বলেন, দেশভাগের আগে পার্বত্য ত্রিপুরা ছিল এক অরণ্যময় পাহাড়ি অঞ্চল। দেশভাগের পর বহু বাঙালি এখানে এসে বসবাস শুরু করেন। তাঁদের কঠোর পরিশ্রম ও অবদানের ফলেই রাজ্যের উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে। “আজ যে উন্নয়নের সুফল জনজাতি ও অন্যান্য সম্প্রদায়ও ভোগ করছে, তার পেছনে বাঙালিদের পরিশ্রম অস্বীকার করা যায় না,”— মন্তব্য করেন রুদ্র পাল।
গৌরাঙ্গ রুদ্র পালের অভিযোগ, এডিসি গঠনের পর থেকেই বামফ্রন্ট সরকার বিভাজনের রাজনীতি করেছে। দীর্ঘ চার দশক ধরে রাজ্যের প্রায় সত্তর শতাংশ এলাকা এডিসির আওতায় থাকা সত্ত্বেও তেমন উন্নয়ন হয়নি। বরং বারবার বাঙালি ও জনজাতিদের মধ্যে বিভাজন ঘটিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি করা হয়েছে।
তিনি দাবি করেন, আজও যে বেকারত্ব ও দারিদ্র্য সমস্যায় রাজ্য জর্জরিত, তার সমাধান হতে পারত যদি বনজ সম্পদ ও রাবারকে কাজে লাগিয়ে শিল্প কলকারখানা গড়ে তোলা হতো। এতে কর্মসংস্থান বাড়ত এবং জাতিগত বিভাজনও দূর হতো। কিন্তু বর্তমান ও অতীত কোনও সরকারই সেই পথে হাঁটেনি।
“আমরা বাঙালি” দলের পক্ষ থেকে এ-ও অভিযোগ আনা হয় যে, রাজপরিবারের বর্তমান উত্তরাধিকারীরা এডিসির উন্নয়নে গুরুত্ব না দিয়ে বরং বারবার বাংলাদেশ প্রসঙ্গ টেনে এনে উত্তেজনা সৃষ্টি করছেন। তাঁদের বক্তব্যে নাকি এমন দাবি করা হচ্ছে যে, বাংলাদেশ থেকে আসা লোকজন গোটা রাজ্য দখল করে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, রাজ্যের দুই মুখ্যমন্ত্রীকে বাংলাদেশি আখ্যা দিয়ে অপমানজনক মন্তব্যও করা হচ্ছে।
এই প্রসঙ্গে রুদ্র পাল বলেন, “ত্রিপুরায় মণিপুরী তাঁতীসহ নানা সম্প্রদায় আছে, যারা সবাই বাংলায় কথা বলে। তাই ত্রিপুরার মালিক বাঙালি বলা কোনও সংবিধানবিরোধী মন্তব্য হতে পারে না।”
সাম্প্রতিক সময়ে দলের এক সভায় “ত্রিপুরার মালিক বাঙালি” মন্তব্য ঘিরে মামলা দায়ের করা হয়েছে। দলের দাবি, তাঁদের জনপ্রিয়তা দেখে শাসক দল ভীত হয়ে এই মামলা করেছে। অথচ যিনি প্রকাশ্যে আগরতলাবাসীকে ‘ভাড়াটে’ বলে কটাক্ষ করেছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে কোনও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
গৌরাঙ্গ রুদ্র পাল অভিযোগ করেন, শুধু শাসক দল নয়, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিও এই ইস্যুতে কার্যত নীরব। “সব দল ভোটের অঙ্ক কষছে। বাঙালিদের উপর অন্যায় হলেও প্রতিবাদ করার সাহস নেই কারও। শুধু আমরা বাঙালি দলই লাগাতার আন্দোলন করে যাচ্ছি,”— তিনি বলেন।
“আমরা বাঙালি” দলের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছে যে, ত্রিপুরার শান্তি ও সম্প্রীতি নষ্ট করে রাজনৈতিক লাভ তুলতে চায় কিছু শক্তি। তাঁদের অভিযোগ, বিভাজনের রাজনীতি ছাড়া কোনও দলের কাছে প্রকৃত উন্নয়নের রোডম্যাপ নেই। অথচ যদি শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানের দিকে গুরুত্ব দেওয়া হতো, তবে জাতিগত বিভেদ দূর হত এবং স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতো।
গৌরাঙ্গ রুদ্র পাল সাংবাদিকদের সামনে একাধিকবার সতর্ক করে বলেন, “ত্রিপুরায় আরেকটি বড় দাঙ্গা বাধানোর নীল নকশা তৈরি হচ্ছে। বারবার শান্ত ত্রিপুরাকে অশান্তির দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।” তিনি দাবি করেন, এর পেছনে রয়েছে “গভীর ষড়যন্ত্র”। উদ্দেশ্য একটাই—বাঙালি ও জনজাতিদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করা।
ত্রিপুরার রাজনীতিতে জাতিগত বিভাজন এবং বাঙালি-জনজাতি সম্পর্ক বরাবরই স্পর্শকাতর ইস্যু। “আমরা বাঙালি” দলের পক্ষ থেকে যে অভিযোগগুলো আনা হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে। শাসক ও বিরোধী—উভয় দলের নীরবতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তারা।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো—ত্রিপুরার রাজনৈতিক নেতৃত্ব কি সত্যিই উন্নয়নের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করবে, নাকি বিভাজনের রাজনীতিই রাজ্যে প্রাধান্য পাবে? উত্তর ভবিষ্যৎই দেবে।