
নিজেকে ত্রিপুরার মালিক বলে দাবি করলেন প্রদ্যোৎ কিশোর দেববর্মণ
আগরতলার মালিক আমি’—বিতর্কে তিপ্রা মথা ত্রিপুরার রাজনীতিতে ফের নতুন ঝড়। দিল্লির যন্তরমন্তরে তিপ্রা মথার ধর্না মঞ্চে দলের সুপ্রিমো ও রাজপরিবারের উত্তরসূরি প্রদ্যোৎ কিশোর দেববর্মণের এক মন্তব্য ঘিরে উত্তাল রাজ্য। ধর্না সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি দাবি করেন—“আগরতলার মালিক তিনিই।” শুধু তাই নয়, ইঙ্গিত দেন সমগ্র রাজ্যই তাঁর অধীনে। পাশাপাশি, আগরতলাবাসী তথা রাজ্যের বাঙালিদের তিনি ‘ভাড়াটে’ বা ‘কিরায়দার’ বলে অভিহিত করেন। মুহূর্তের মধ্যেই মন্তব্যটি তীব্র সমালোচনার জন্ম দেয়।
এই বক্তব্যে প্রথম প্রতিক্রিয়া আসে আমরা বাঙালি সংগঠনের তরফে। তাঁদের দাবি—স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে রাজতন্ত্রের অবসান হয়েছে, ফলে প্রদ্যোতের এ ধরনের মন্তব্য একেবারেই সংবিধানবিরোধী। সংগঠনটির মতে, ত্রিপুরা বহু দশক ধরে বিভিন্ন জাতি ও জনজাতির মিলনস্থল। সেখানে কোনো সম্প্রদায়কে ‘ভাড়াটে’ বলা নিঃসন্দেহে অপমানজনক।
আমরা বাঙালি সংগঠন আরও অভিযোগ করেছে, দীর্ঘদিন ধরেই বাঙালি সমাজকে পরিকল্পিতভাবে হেয় করার চেষ্টা চলছে। তাঁদের বক্তব্য, ‘‘দশক ধরে যে-ই ক্ষমতায় এসেছে, বাঙালিদের স্বার্থ সুরক্ষিত হয়নি। এখন সময় এসেছে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলনে নামার।’’
প্রদ্যোৎ কিশোরের মতে, আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য হল কেন্দ্রের সঙ্গে হওয়া ত্রিপাক্ষিক চুক্তি বাস্তবায়ন। ওই চুক্তি অনুযায়ী, স্বশাসিত জেলা পরিষদে (ADC) ২৫টি আসন সংরক্ষণের পাশাপাশি মুণিপুরী সম্প্রদায়ের জন্য একটি বিশেষ আসনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘ ১৮ মাস কেটে গেলেও চুক্তি কার্যকর হয়নি।
রাজনৈতিক মহলের বিশ্লেষণ—আসন্ন ভিলেজ কমিটি নির্বাচনকে সামনে রেখে তিপ্রা মথা নিজেদের কর্মীদের চাঙ্গা করতে এবং সমর্থন বাড়াতে এই ধরণের কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
এই ধর্না সভায় উপস্থিত ছিলেন বিজেপি সাংসদ কৃতি সিং। মঞ্চে উঠে তিনি তিপ্রা মথার আন্দোলনের প্রতি প্রকাশ্যে সমর্থন জানান। কিন্তু এখানেই বাড়ছে বিতর্ক। বাঙালি সংগঠনগুলির অভিযোগ, অতীতে কৃতি সিংও বাঙালিদের ‘রিফিউজি’ ও ‘বাংলাদেশি’ বলে কটাক্ষ করেছেন। তাঁদের মতে, একজন সাংসদ হয়েও বারবার এই ধরণের মন্তব্য রাজ্যের জাতি-উপজাতির মধ্যে বিভেদ আরও বাড়াচ্ছে।
আমরা বাঙালি সংগঠন ইতিহাসের উদাহরণ টেনে দাবি করেছে, অতীতে ত্রিপুরার রাজপরিবার এবং সমতল ত্রিপুরার বাঙালিদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তাঁদের বক্তব্য, রাজপরিবারের আমন্ত্রণে একাধিকবার কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ত্রিপুরায় এসেছিলেন এবং সে সময়ে পারস্পরিক সৌহার্দ্য বজায় ছিল। কিন্তু বর্তমান রাজনীতি সেই ঐতিহ্য ভেঙে দিচ্ছে এবং জাতিগত বিভাজনকে উস্কে দিচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে মুখ খুলেছেন কংগ্রেস বিধায়ক সুদীপ রায় বর্মন। প্রদেশ কংগ্রেস ভবনে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি স্পষ্টভাবে বলেন, “ত্রিপুরার মালিক জনগণ। এখানে আমার, আপনার, প্রদ্যোতবাবু সহ প্রত্যেক নাগরিকের সমান অধিকার রয়েছে। প্রদ্যোতের মন্তব্য অযৌক্তিক এবং হতাশা থেকেই এসেছে।”
তিনি আরও যোগ করেন, “এখনও যদি প্রদ্যোতের মানসিকতা রাজন্য শাসনের ধ্যানধারণায় আটকে থাকে, তবে তা পরিবর্তন করা প্রয়োজন। কারণ, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণই সর্বশক্তিমান।’’
সুদীপ রায় বর্মনের মতে, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার এখনও পর্যন্ত ত্রিপাক্ষিক চুক্তি কার্যকর করেনি। ছয় মাসের মধ্যে সমাধানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও ১৮ মাস পেরিয়ে গেছে। ঠিক এই কারণেই প্রদ্যোৎ হতাশ হয়ে পড়েছেন এবং নিজেকে ‘ত্রিপুরার মালিক’ বলে দাবি করেছেন। তাঁর কথায়, “আসন্ন ভিলেজ কমিটি নির্বাচনের আগে প্রদ্যোতের কাছে তিপ্রাসাদের কী জবাব থাকবে, সেই চিন্তা থেকেই তিনি এ ধরনের মন্তব্য করেছেন।”
ত্রিপুরার রাজনীতি বরাবরই জাতি ও জনজাতির প্রশ্নে সংবেদনশীল। প্রদ্যোৎ কিশোরের মন্তব্য শুধু রাজনৈতিক বিতর্কই নয়, সামাজিক উত্তেজনাও তৈরি করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী দিনে এই ইস্যু ত্রিপুরার মূলধারার রাজনীতিতে বড় ভূমিকা নিতে পারে। বাঙালি সমাজের মধ্যে ক্ষোভ বাড়লে তা বিজেপি ও কংগ্রেস উভয়ের জন্যই রাজনৈতিকভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারে।
যদিও প্রদ্যোতের বক্তব্য নিয়ে প্রবল সমালোচনা হয়েছে, তবু তাঁর সমর্থকরাও যুক্তি দিচ্ছেন। তাঁদের দাবি, “প্রদ্যোৎ ইচ্ছাকৃতভাবে কারও অনুভূতিতে আঘাত করতে চাননি। বরং কেন্দ্রের প্রতি হতাশা থেকেই তিনি চরমপন্থী মন্তব্য করেছেন।”
তবে বিরোধীরা বলছে, জনসমক্ষে এই ধরনের মন্তব্য রাজ্যবাসীর মধ্যে বিভাজন তৈরি করবে। “ত্রিপুরা হলো বহুসাংস্কৃতিক রাজ্য। এখানে সবাই সমানভাবে নাগরিক। কারো মালিকানা দাবি করার কোনো সুযোগ নেই,” মন্তব্য করেছেন এক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক।
দিল্লির যন্তরমন্তরের ধর্না মঞ্চ থেকে ছড়িয়ে পড়া এই বিতর্ক আপাতত ত্রিপুরার রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ তৈরি করেছে। প্রদ্যোৎ কিশোর দেববর্মণের মন্তব্য রাজ্যজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিলেও, এর আড়ালে লুকিয়ে আছে ত্রিপাক্ষিক চুক্তি বাস্তবায়নের প্রশ্ন। সামনেই ভিলেজ কমিটি নির্বাচন, আর সেই প্রেক্ষাপটে এই ইস্যু কতটা প্রভাব ফেলবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।