
নেপালের পরিস্থিতির পিছনে কি আমেরিকার হাত ? এটাই বড় প্রশ্ন
দক্ষিণ এশিয়ার পাহাড়ি দেশ নেপালের পরিস্থিতি ভয়াবহ। রাজধানী কাঠমান্ডুর রাস্তায় তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বে চলছে বিক্ষোভ—যেখানে দুর্নীতি, বেকারত্ব, স্বজনপোষণ ও সরকারের অদক্ষতার বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ বিস্ফোরিত হচ্ছে। তবে অনেক বিশ্লেষক বলছেন, এর নেপথ্যে রয়েছে বৃহৎ ভূরাজনৈতিক টানাপোড়েন, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের প্রতিযোগিতা।
বর্তমান তরঙ্গের শিকড় খুঁজতে গেলে যেতে হয় ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। সেবছর হাজার হাজার মানুষ এমসিসি (মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কর্পোরেশন) চুক্তির বিরুদ্ধে রাস্তায় নামে। যুক্তরাষ্ট্রের এই সংস্থাটি ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়, যার ঘোষিত লক্ষ্য উন্নয়ন সহায়তা, কিন্তু সমালোচকদের মতে এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য নিরাপত্তা ও কৌশলগত স্বার্থ রক্ষা করা।
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২-এ নেপালি সংসদ এমসিসি চুক্তি অনুমোদন করে। চুক্তি অনুযায়ী, নেপাল ৫০০ মিলিয়ন ডলার অনুদান পাবে এবং নিজস্বভাবে ১৩০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে বিদ্যুৎ অবকাঠামো ও সীমান্ত-পার বিদ্যুৎ সংযোগ উন্নয়নের জন্য। সমর্থকদের মতে এটি অর্থনীতিকে এগিয়ে নেবে, কিন্তু বিরোধীদের অভিযোগ—এটি আসলে নেপালকে মার্কিন কৌশলগত বলয়ে টেনে আনার একটি উপায়।
মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞরা স্বীকার করেন, এমসিসির কাঠামো কেবল উন্নয়ন সহায়তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বোর্ডের শীর্ষ পদে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও কোষাধ্যক্ষের উপস্থিতি এর কূটনৈতিক গুরুত্ব স্পষ্ট করে। সমালোচকদের দাবি, এটি “সফট পাওয়ার” এর আড়ালে দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন উপস্থিতি বাড়ানোর এক প্রকল্প।
তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, নেপালের মতো দুর্বল রাষ্ট্রকে ঘিরে রাখার উদ্দেশ্যই মূলত নিরাপত্তা ও কৌশলগত অবস্থান শক্তিশালী করা। জর্জ ডব্লিউ বুশ প্রশাসনের সময় থেকেই এই চিন্তা চালু ছিল—“দুর্বল রাষ্ট্রগুলোও আমেরিকার জন্য হুমকি”। ফলে, অনেকের মতে, এমসিসি নেপালের সার্বভৌমত্ব নিয়ে প্রশ্ন তৈরি করছে।
নেপালের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরেই বামপন্থীরা প্রভাবশালী। একসময় মাওবাদী গেরিলা বাহিনী সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে রাজতন্ত্রের পতনে ভূমিকা রাখে। কিন্তু গৃহযুদ্ধ শেষে ক্ষমতায় এসে বাম দলগুলো দ্রুত দুর্নীতি, বিভাজন ও ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। প্রচণ্ড, বাবুরাম ভট্টরাই বা কেপি শর্মা ওলি—সবাইই কখনো না কখনো স্বজনপোষণ বা অদক্ষতার অভিযোগের মুখে পড়েছেন।
এ অবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে, নেপালের বাম রাজনীতি আর আগের মতো সংগঠিত শক্তি নয়। তবুও বামপন্থীরা চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ায় ওয়াশিংটনের অস্বস্তি বেড়েছে। বিশেষজ্ঞ আনন্দ স্বরূপ ভার্মার মতে, “ওয়াশিংটন নেপালে কমিউনিস্টদের বিকশিত হতে দিতে চায় না। তারা যেকোনোভাবে এই শক্তিকে দুর্বল করতে চাইছে।”
নেপালের বর্তমান রাজনৈতিক অভিমুখ চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের দিকেই ঝুঁকে আছে। ওলি ক্ষমতায় থাকার সময় বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI)-এ যোগ দেয়া, সীমান্ত বিতর্কে ভারতের বিরোধিতা করা এবং নতুন মানচিত্র প্রকাশ করা এসবই বেইজিংয়ের প্রভাবের ইঙ্গিত বহন করে।
তিয়ানজিনে অনুষ্ঠিত এসসিও সম্মেলনে শি জিনপিংয়ের সঙ্গে ওলির সাক্ষাৎ এবং ভারত-চীন সীমান্ত বাণিজ্য বিরোধিতা নেপালের অবস্থানকে আরও স্পষ্ট করেছে। ওয়াশিংটনের জন্য এটি নিঃসন্দেহে একটি অস্বস্তিকর বার্তা।
আজকের বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিচ্ছে মূলত জেন জি (Gen Z) প্রজন্ম। তাদের দাবিগুলো খুবই স্থানীয়—দুর্নীতি, বেকারত্ব, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে অব্যবস্থা। কিন্তু বিশ্লেষকদের মতে, এই ক্ষোভকে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো ব্যবহার করতে পারে নিজেদের কৌশলগত লক্ষ্য পূরণের জন্য।
এক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠছে—ওয়াশিংটন কি সত্যিই নেপালের তরুণ আন্দোলনকে পৃষ্ঠপোষকতা করছে, যাতে বাম শক্তিগুলো আরও দুর্বল হয় এবং দেশটি মার্কিন মিত্রপক্ষের সঙ্গে যুক্ত থাকে? এর সরাসরি প্রমাণ পাওয়া কঠিন, তবে অতীতের অভিজ্ঞতা ইঙ্গিত দেয় যে, দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারে যুক্তরাষ্ট্র নানান কৌশল ব্যবহার করে এসেছে।
বর্তমান পরিস্থিতি নেপালের ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কির নাম আলোচনায় আসছে। তাঁকে অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে দেখা হয়, যিনি একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্ব দিতে পারেন।
তবে প্রশ্ন হলো—এই পরিবর্তন কি জনগণের দুর্দশা লাঘব করবে, নাকি আবারও বিদেশি শক্তির প্রভাবের নতুন অধ্যায় শুরু করবে?
নেপালের সংকট কেবল দুর্নীতি বা শাসন ব্যর্থতার ফসল নয়; এটি দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিরও প্রতিফলন। চীন ও ভারতের মাঝে অবস্থান করা এই হিমালয় রাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলোর কৌশলগত খেলায় জড়িয়ে আছে। আজকের বিক্ষোভ তাই দ্বিমুখী—একদিকে জনগণের ন্যায্য দাবি, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক শক্তির স্বার্থ।
নেপালের তরুণরা পরিবর্তন চায়, কিন্তু তারা কি নিজেদের কণ্ঠকে বড় শক্তির হাতিয়ার হতে দেবে, নাকি সত্যিই একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারবে—এটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
📌 দেখুন আজকের ত্রিপুরার বাছাই করা খবর
👇 ভিডিও লিঙ্কে ক্লিক করুন: