
বাথরুমে প্রসব, নবজাতকের দেহ ব্যাগে লুকিয়ে পালানোর চেষ্টা — স্বামী আটক
ত্রিপুরার সবচেয়ে বড় সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র, আগরতলার জিবি হাসপাতালে এক মর্মান্তিক এবং চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটেছে। মোহনপুর মহকুমার কলকলিয়া এলাকার বাসিন্দা নিপু দাস নিজের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিয়ে আসেন। কিন্তু চিকিৎসকের কাছে পৌঁছনোর আগেই হাসপাতালের বাথরুমেই প্রসূতির প্রসব যন্ত্রণা শুরু হয় এবং জন্ম নেয় একটি পুত্র সন্তান।
কিন্তু জন্মের পরপরই পরিস্থিতি নাটকীয় মোড় নেয়। প্রসূতির হাতে কেবল প্লাসেন্টা পাওয়া গেলেও নবজাতক কোথায় — সেই প্রশ্ন ওঠে। কিছুক্ষণ পরেই নিরাপত্তারক্ষীরা লক্ষ্য করেন, নিপু দাস দ্রুত হাসপাতাল চত্বরে বেরিয়ে যাচ্ছেন, হাতে একটি বাজারের ব্যাগ। সন্দেহবশত ব্যাগটি পরীক্ষা করলে ভেতরে নবজাতকের দেহ পাওয়া যায়। এর পরই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে হাসপাতাল জুড়ে।
শুক্রবার রাতে গর্ভবতী মহিলার তীব্র ব্যথা শুরু হয়। পরিবার দাবি করছে, দাঁতের ব্যথার ওষুধ খাওয়ার পর হঠাৎই প্রসব যন্ত্রণা শুরু হয়। সকালে তাঁকে জিবি হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। চিকিৎসকেরা কয়েকটি পরীক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, কিন্তু তার আগেই হঠাৎ করেই শৌচাগারে প্রসব হয়ে যায়।
চিকিৎসক ও নার্সরা প্রথমে ভেবেছিলেন, শিশুটিকে আলাদা কোথাও রাখা হয়েছে। কিন্তু প্রসূতির কাছ থেকে সন্তোষজনক উত্তর না মেলায় সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়।
এমন সময় হাসপাতালে কর্মরত বেসরকারি নিরাপত্তারক্ষীরা দেখেন, স্বামী নিপু দাস একটি বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে তাড়াহুড়ো করে হাসপাতালের বাইরে যাচ্ছেন। তাঁদের সন্দেহ হয় এবং তাঁরা তাঁকে আটকে ব্যাগ পরীক্ষা করেন। তখনই প্রকাশ্যে আসে ভয়াবহ সত্য—ব্যাগের ভেতরে রয়েছে সদ্যোজাত শিশুর নিথর দেহ।
খবর ছড়িয়ে পড়তেই হাসপাতাল চত্বরে ভিড় জমে যায়। সাধারণ মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়েন। অনেকে অভিযুক্তকে ঘিরে ধরেন এবং পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার দাবি জানান।
খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে আসে পশ্চিম আগরতলা থানার পুলিশ। নিপু দাসকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়। নবজাতকের মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়। শিশুর মৃত্যু প্রসবকালীন জটিলতার কারণে হয়েছে, না অন্য কোনও কারণে—তা জানতে ফরেনসিক রিপোর্টের অপেক্ষা করা হচ্ছে।
পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনাটি অত্যন্ত গুরুতর। কেন স্বামী নবজাতককে লুকিয়ে বাইরে নিয়ে যেতে চাইছিলেন, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে খুন, প্রমাণ লোপাট বা অসতর্কতার অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
পুলিশি জেরায় নিপু দাস দাবি করেছেন, সন্তান জন্মের সময় থেকেই মৃত ছিল। স্ত্রীর নির্দেশেই তিনি শিশুটিকে ব্যাগে করে বাইরে নিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর কথায়, “স্ত্রী আমাকে বলেছিল, মৃত সন্তানকে বাইরে নিয়ে যেতে। তাই আমি ব্যাগে করে বেরোচ্ছিলাম।”
তবে এই বক্তব্য নিয়ে তীব্র সন্দেহ প্রকাশ করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয়রা। প্রশ্ন উঠছে—যদি শিশুটি জন্ম থেকেই মৃত হয়, তবে কেন গোপনে লুকিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হলো? চিকিৎসক বা নার্সদের না জানিয়ে ব্যাগে ভরে পালানোর মানে কী?
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক। প্রসূতির চিকিৎসা ও নিরাপত্তার জন্য সবরকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে কীভাবে এমন ঘটনা ঘটল, তা খতিয়ে দেখতে আলাদা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
তবে এই ঘটনার পর থেকেই প্রশ্ন উঠছে, জিবি হাসপাতালের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় গলদ রয়েছে কি না। এত বড় একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কীভাবে কেউ নবজাতকের দেহ ব্যাগে করে বাইরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারে—এই প্রশ্ন নিয়েই তীব্র আলোচনা শুরু হয়েছে।
হাসপাতালে উপস্থিত অন্য রোগী ও তাঁদের পরিবার ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এক প্রত্যক্ষদর্শীর কথায়,
“আমরা দেখেছি লোকটা ব্যাগ নিয়ে দ্রুত বেরোচ্ছে। পরে শুনলাম ভেতরে শিশুর দেহ। খুব ভয়ঙ্কর দৃশ্য। হাসপাতালের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও কড়াকড়ি হওয়া উচিত।”
আরেকজন বলেন, “শিশু জন্মের পরপরই এমন ঘটনা ঘটলে মানুষের মনে হাসপাতালের ওপর আস্থা কমে যাবে। প্রশাসনকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।”
এই ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়তেই গোটা রাজ্যে তীব্র আলোড়ন তৈরি হয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে মানুষ ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন। অনেকেই বলছেন, দরিদ্র পরিবারগুলি অনেক সময় চিকিৎসা ব্যয়ের ভয়ে এমন চরম সিদ্ধান্ত নেয়। আবার কেউ কেউ মনে করছেন, নবজাতকের মৃত্যুতে অন্য কোনও রহস্যও থাকতে পারে।
পুলিশ ইতিমধ্যেই প্রসূতির শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণে রেখেছে। নবজাতকের মৃত্যুর সঠিক কারণ জানতে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে বলে জানানো হয়েছে। পাশাপাশি, স্বামীর আচরণ ও তাঁর বক্তব্যের মধ্যে কোনও অসঙ্গতি রয়েছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
জিবি হাসপাতালের এই ঘটনা কেবল একটি পরিবারের নয়, গোটা সমাজকে নাড়িয়ে দিয়েছে। জন্মের পরপরই একটি শিশুর দেহ ব্যাগে ভরে লুকিয়ে পালানোর চেষ্টা—এমন ঘটনা কেবল ভয়ঙ্করই নয়, গভীর রহস্যও বহন করছে।
পুলিশ ও হাসপাতালের দ্বিমুখী তদন্তের ফলেই সামনে আসবে প্রকৃত সত্য। তবে ইতিমধ্যেই এই ঘটনা রাজ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থা, নিরাপত্তা এবং মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে।