আজ ত্রিপুরা রাজ্যের সচিবালয় প্রাঙ্গণে এক গৌরবময় আবহে পালিত হলো ‘বন্দে মাতরম’ গান রচনার ১৫০ বছর পূর্তি উদযাপন। মুখ্যমন্ত্রী প্রফেসর (ডা.) মানিক সাহার উপস্থিতিতে আয়োজিত এই রাজ্যভিত্তিক অনুষ্ঠানটি শুধুমাত্র একটি স্মারক দিবস নয়, বরং জাতির অন্তরে দেশপ্রেমের নবজাগরণ ঘটানোর এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত হিসেবে স্মরণীয় হয়ে রইল।
অনুষ্ঠানের সূচনায় মুখ্যমন্ত্রী ও অন্যান্য অতিথিবৃন্দ ভারতমাতার প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর প্রদর্শিত হয় একটি স্বল্প দৈর্ঘ্যের তথ্যচিত্র, যেখানে তুলে ধরা হয় ‘বন্দে মাতরম’ গানের ইতিহাস, প্রেক্ষাপট এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে এর অমূল্য ভূমিকা।
অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ ছিল ১৫০ জন শিল্পীর সমবেত কণ্ঠে পরিবেশিত “বন্দে মাতরম” গান—যা প্রাঙ্গণ জুড়ে সৃষ্টি করে এক গভীর আবেগঘন পরিবেশ।রাজ্য সরকারের আয়োজিত এই অনুষ্ঠানের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিল নয়াদিল্লিতে আয়োজিত কেন্দ্রীয় অনুষ্ঠান, যেখানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেশবাসীর উদ্দেশ্যে বক্তৃতা রাখেন।
সেই সরাসরি সম্প্রচার সচিবালয় প্রাঙ্গণে উপস্থিত সবাই একসঙ্গে উপভোগ করেন।মুখ্যমন্ত্রী মানিক সাহা তাঁর বক্তব্যে বলেন, “বন্দে মাতরম শুধু একটি গান নয়, এটি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের আত্মা।” তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, গত ১ অক্টোবর কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা ‘বন্দে মাতরম’-এর ১৫০তম বর্ষপূর্তি পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়। এর মূল উদ্দেশ্য—দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে এই গানের ঐতিহাসিক ভূমিকা নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
মুখ্যমন্ত্রী জানান, ১৮৭৫ সালের ৭ নভেম্বর বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর অমর কাব্য *আনন্দমঠ*-এর অংশ হিসেবে ‘বন্দে মাতরম’ রচনা করেন। পরবর্তীতে ১৮৯৬ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই গানটি গেয়ে শোনান—যা দ্রুতই স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মধ্যে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে ওঠে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় ‘বন্দে মাতরম’ হয়ে ওঠে বাঙালি জাতীয় চেতনার প্রতীক, এবং ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের এক অনিবার্য স্লোগান।মুখ্যমন্ত্রী আরও স্মরণ করিয়ে দেন, আজাদ হিন্দ সরকারের ঘোষণার সময়েও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে এই গানটি গাওয়া হয়েছিল।
এমনকি ১৯৫০ সালের ২৪ জানুয়ারি ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ গণ পরিষদে ঘোষণা করেন—স্বাধীনতা সংগ্রামে ‘বন্দে মাতরম’-এর অপরিসীম ভূমিকার কারণে এটিকে জাতীয় সঙ্গীত *জন গণ মন*-এর সমান মর্যাদা দেওয়া হবে।এই বর্ষপূর্তি উদ্যাপনকে ঘিরে মুখ্যমন্ত্রী জানান, ৭ নভেম্বর ২০২৫ থেকে ৭ নভেম্বর ২০২৬ পর্যন্ত সারাদেশে চারটি পর্যায়ে উদযাপনের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এর আওতায় রাজ্যজুড়ে স্কুল, কলেজ, জেলা সদর, মহকুমা, ব্লক এবং পুরসভাগুলিতে বিশেষ অনুষ্ঠান, প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক আয়োজন অনুষ্ঠিত হবে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আয়োজন করা হবে ‘বন্দে মাতরম’-কেন্দ্রিক প্রবন্ধ ও বিতর্ক প্রতিযোগিতা, পোস্টার নির্মাণ, কুইজ, বিশেষ সমাবেশ এবং দেশাত্মবোধক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। রাজ্য পুলিশের ব্যান্ড ও স্থানীয় শিল্পীরা জনবহুল এলাকায় দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করবেন। পাশাপাশি আয়োজন করা হবে বৃক্ষরোপণ অভিযান, যুব ম্যারাথন, মশাল দৌড় এবং এনসিসি, এনএসএস ব্যান্ডের মাধ্যমে ক্যাম্পাসে বিশেষ সংগীতানুষ্ঠান।
এই কর্মসূচির উদ্দেশ্য সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “এই উদ্যাপন শুধু অতীত স্মরণ নয়, এটি আগামী প্রজন্মকে দেশপ্রেম ও দায়িত্ববোধে উদ্বুদ্ধ করার এক মহত্ প্রচেষ্টা।” তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আহ্বানে সাড়া দিয়ে গোটা ভারতবাসী আবারও এক নতুন দেশাত্মবোধের স্রোতে ভেসে উঠবে।
অনুষ্ঠানের শেষাংশে মুখ্যমন্ত্রী ও অন্যান্য অতিথিগণ ‘বন্দে মাতরম’ বিষয়ক একটি চিত্র প্রদর্শনী পরিদর্শন করেন, যেখানে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অবদানকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়।অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মুখ্যসচিব জে. কে. সিনহা, তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের সচিব ড. পি. কে. চক্রবর্তী, রাজ্য প্রশাসনের প্রধান সচিব, সচিব, অধিকর্তা এবং বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ।
‘বন্দে মাতরম’-এর এই ১৫০ বছর পূর্তি উদযাপন নিঃসন্দেহে ভারতের ইতিহাসে এক স্মরণীয় অধ্যায়। এটি শুধু একটি গান নয়—একটি যুগের স্লোগান, এক জাতির আত্মার প্রতিধ্বনি, যা আজও কোটি ভারতবাসীর মনে দেশপ্রেমের আগুন জ্বালিয়ে রাখে।বন্দে মাতরম—এই দুই শব্দ আজও আমাদের মাটির গন্ধ, ত্যাগের স্মৃতি ও স্বাধীনতার শপথের প্রতীক।