শুক্রবার সকালে বিশালগড়ের নিউ মার্কেট এলাকায় ঘটে গেল এক উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনা, যা মুহূর্তের মধ্যেই সারা এলাকায় চাঞ্চল্য ছড়িয়ে দেয়। প্রকাশ্যে বিএসএফের গাড়ি ভাঙচুর ও জওয়ানদের উপর হামলার অভিযোগে এখন উত্তাল বিশালগড়। ঘটনার জেরে আবারও প্রশ্ন উঠেছে জেলার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ঘিরে।
সূত্রের খবর অনুযায়ী, শুক্রবার সকালে কামথানার দিক থেকে একটি গরুবোঝাই ট্রাক বিশালগড়ের দিকে আসছিল। কামথানা বিওপি (বর্ডার আউট পোস্ট)-এর বিএসএফ জওয়ানরা নিয়মিত টহলের অংশ হিসেবে গাড়িটিকে থামানোর নির্দেশ দেন। কিন্তু চালক সেই নির্দেশ উপেক্ষা করে ট্রাকটি দ্রুতগতিতে এগিয়ে যায়।বিএসএফের সন্দেহ ছিল, ওই গাড়িতে হয়তো বেআইনি গবাদি পশু পাচারের চেষ্টা চলছে। ফলে তারা গাড়িটিকে অনুসরণ করতে থাকে। কিন্তু বিশালগড় বাজার এলাকায় ঢোকার সময় ঘটনাটি ভয়াবহ আকার নেয়। দ্রুতগতির ট্রাকটি প্রথমে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা দুটি গাড়িতে ধাক্কা মারে এবং এরপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সোজা গিয়ে প্রবেশ করে নিউ মার্কেট এলাকার সাপ্তাহিক গরুর হাটে।
ঘটনাস্থলে বিএসএফের টহলদল পৌঁছাতেই হাটে উপস্থিত কিছু ব্যক্তি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে বলে স্থানীয়দের দাবি। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, হঠাৎ করেই বাজার এলাকায় অজানা গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে বিএসএফ নাকি “অকারণে” গরুর গাড়ি ধরার চেষ্টা করছে। মুহূর্তের মধ্যেই কয়েকজন ব্যবসায়ী ও শ্রমিক ক্ষোভ প্রকাশ করতে শুরু করেন।পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার আগেই কয়েকজন ক্ষুব্ধ ব্যক্তি বিএসএফের গাড়িকে ঘিরে ধরে। এরপর শুরু হয় ভাঙচুর ও উত্তেজনা। একপর্যায়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের উপরও হামলার ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ। জওয়ানদের দিকে ইট-পাথর ছোঁড়া হয়, এমনকি লাঠিসোঁটা নিয়েও আঘাত করা হয় বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
এই ঘটনায় বেশ কয়েকজন বিএসএফ জওয়ান আহত হয়েছেন। আহতদের তৎক্ষণাৎ নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। বিশালগড় থানার পুলিশ খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পুলিশের উপস্থিতিতে বাজারের পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়, যদিও কিছুক্ষণ পর্যন্ত এলাকায় আতঙ্কের পরিবেশ বজায় ছিল।পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, বাজার এলাকায় অতিরিক্ত বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে যাতে নতুন করে কোনো অশান্তি না ছড়ায়। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করতে বাজারের সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
ঘটনার পর স্থানীয় প্রশাসন ও বিএসএফ কর্তৃপক্ষ উভয়েই ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শুরু করেছে। প্রশাসনের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, “যে বা যারা আইন হাতে তুলেছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নিরাপত্তা বাহিনীর উপর হামলা কোনোভাবেই বরদাস্ত করা হবে না।”অন্যদিকে বিএসএফের পক্ষ থেকেও জানানো হয়েছে, সীমান্ত এলাকায় বেআইনি গরু পাচার রোধে নিয়মিত অভিযান চলছে। তারা স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় রেখে কাজ করছে এবং এই ঘটনার পেছনে কারা প্ররোচনা দিয়েছে, তা খুঁজে বের করা হবে।
বিশালগড়ের নিউ মার্কেট এলাকার ব্যবসায়ী সমাজ এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ অভিযোগ করছেন, বিএসএফের টহলদল কখনও কখনও অপ্রয়োজনে হাটে এসে গরুর ব্যবসায়ীদের হয়রানি করে। অন্যদিকে, অনেকে মনে করছেন, নিরাপত্তা বাহিনীর উপর হামলা একেবারেই অনুচিত এবং এটি প্রশাসনের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ।এক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, “বিএসএফ তো আমাদের নিরাপত্তার জন্যই কাজ করে। তাদের উপর আক্রমণ মানে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া। এটা বরদাস্ত করা যায় না।”অন্যদিকে এক গরুর ব্যবসায়ী জানান, “হাটে হঠাৎ গাড়ি ঢুকে পড়ায় সবাই আতঙ্কিত হয়ে যায়। কে কাকে মারছে, কে কাকে থামাচ্ছে — কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না।”
আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে উদ্বেগএই ঘটনার পর থেকে বিশালগড়ে নতুন করে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে এলাকাজুড়ে গরু পাচার, অবৈধ পরিবহন ও সীমান্ত সংলগ্ন অঞ্চলে টহল সংক্রান্ত নানা বিতর্ক তৈরি হয়েছে। প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে, ভবিষ্যতে এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে বিএসএফ ও স্থানীয় পুলিশের মধ্যে আরও সমন্বয় বাড়ানো হবে।এক প্রশাসনিক কর্মকর্তা বলেন, “গবাদি পশুর হাটে যাতে নিরাপত্তা বজায় থাকে এবং সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত না হয়, সেজন্য নিয়মিত পুলিশি টহল চালানো হবে। একই সঙ্গে গুজব রটনাকারীদের বিরুদ্ধেও পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”
তদন্ত ও পরবর্তী ব্যবস্থাঘটনার তদন্তের জন্য একটি বিশেষ দল গঠন করা হয়েছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, হামলায় জড়িত সন্দেহভাজন কয়েকজনকে ইতিমধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে। পুলিশের তরফে জানানো হয়েছে, সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।প্রশাসন আশ্বাস দিয়েছে, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সবরকম ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে, তার জন্য কঠোর নজরদারি চালানো হবে।
বিএসএফের উপর এই প্রকাশ্য হামলা নিঃসন্দেহে বিশালগড় তথা রাজ্যের নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য এক বড় সতর্কবার্তা। একদিকে যেমন স্থানীয় জনতার ক্ষোভ ও আতঙ্ক প্রশাসনের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, অন্যদিকে নিরাপত্তা বাহিনীর মর্যাদা ও দায়িত্ব রক্ষায় আরও দৃঢ় অবস্থান নেওয়ার দাবি উঠেছে।