ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলের রাজনীতিতে শুরু হলো এক ঐতিহাসিক অধ্যায়। প্রথমবারের মতো অঞ্চলটির চার রাজ্যের শীর্ষ নেতারা এক মঞ্চে এসে ঘোষণা করলেন এক ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম — ‘ওয়ান নর্থ ইস্ট’। মঙ্গলবার নয়াদিল্লিতে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশিত বিবৃতিতে এই মঞ্চের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করা হয়।এই নতুন রাজনৈতিক উদ্যোগের লক্ষ্য, উত্তর–পূর্ব ভারতের জনগণের দীর্ঘদিনের দাবি—স্বার্থরক্ষা, সাংস্কৃতিক পরিচয় ও উন্নয়নের অধিকার—জাতীয় স্তরে একক কণ্ঠে তুলে ধরা। দীর্ঘদিন ধরে নানা ভাষা, জাতি ও ধর্মের বৈচিত্র্যে ভরপুর এই অঞ্চলের মানুষ নিজেদের প্রান্তিক মনে করে আসছেন।
এবার তাঁদের সেই বহু বছরের বঞ্চনার অনুভূতিকে রাজনৈতিক শক্তিতে রূপ দিতে চায় এই নতুন মঞ্চ। চার রাজ্যের ঐতিহাসিক ঐক্য যৌথ ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন — মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) সভাপতি **কনরাড কে. সাংমা, ত্রিপুরার তিপ্রা মথা পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ও রাজপরিবারের উত্তরসূরি, প্রদ্যোত বিক্রম মাণিক্য দেববর্মন, নাগাল্যান্ডের প্রাক্তন বিজেপি মুখপাত্র ও রাজ্যের বর্তমান মন্ত্রী ম্হোনলুমো কিকন, এবং আসামের পিপলস পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ও তরুণ নেতা ড্যানিয়েল ল্যাংথাসা।এই চার নেতার মতে, “উত্তর–পূর্ব ভারতের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে একই সমস্যায় ভুগলেও তাদের কণ্ঠস্বর ছড়িয়ে–ছিটিয়ে গেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে।
এখন সময় এসেছে এই সব কণ্ঠকে একত্রিত করে শক্তিশালী, মর্যাদাসম্পন্ন এক ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার।”নেতারা জানান, ‘ওয়ান নর্থ ইস্ট’ কোনও একক দলের উদ্যোগ নয়, বরং এটি একটি আঞ্চলিক জোট ও মতাদর্শিক আন্দোলন, যার উদ্দেশ্য অঞ্চলটির উন্নয়নকে একসঙ্গে এগিয়ে নেওয়া। তাঁদের মতে, এটি কোনও বিভাজনের রাজনীতি নয়, বরং উত্তর–পূর্বের আট রাজ্যের (ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরাম, অরুণাচল প্রদেশ ও সিকিম) মানুষের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রথম ধাপ উত্তর–পূর্ব ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস মূলত রাজ্যভিত্তিক রাজনীতির ওপর নির্ভরশীল। জাতিগত বিভাজন, পাহাড় ও সমতলের দ্বন্দ্ব, এবং মূল ভারতের সঙ্গে যোগাযোগের ঘাটতি — সব মিলিয়ে অঞ্চলটি বহু বছর ধরেই রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতায় ভুগছে। প্রতিটি রাজ্যের আলাদা আঞ্চলিক দল থাকলেও, সমগ্র উত্তর–পূর্বের জন্য একক কণ্ঠে কথা বলার প্ল্যাটফর্ম কখনও গড়ে ওঠেনি।
এই প্রেক্ষাপটে ‘ওয়ান নর্থ ইস্ট’-এর উদ্ভবকে বিশ্লেষকরা দেখছেন এক “নতুন রাজনৈতিক এক্সপেরিমেন্ট”হিসেবে। তাঁদের মতে, এই উদ্যোগ সফল হলে তা শুধু উত্তর–পূর্বের রাজনীতিকেই বদলে দেবে না, বরং ভারতের জাতীয় রাজনীতিতেও নতুন সমীকরণ তৈরি করবে।
নেতাদের যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘ওয়ান নর্থ ইস্ট’-এর মূল লক্ষ্য তিনটি, উন্নয়নের দাবিকে একক কণ্ঠে জাতীয় মঞ্চে তুলে ধরা। আঞ্চলিক পরিচয় ও সংস্কৃতির সংরক্ষণ নিশ্চিত করা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে উত্তর–পূর্বের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা।
নেতারা আরও জানান, প্রায় আড়াই কোটি মানুষের স্বার্থে এই ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে একটি স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হবে, যা নতুন রাজনৈতিক সত্তার কাঠামো, কর্মপদ্ধতি ও নীতিগত দিক নির্ধারণ করবে।কনরাড সাংমা বলেন, “উত্তর–পূর্বের মানুষ অনেক সময়ই মনে করেন, তাঁদের কথা জাতীয় রাজনীতিতে শোনা যায় না। ‘ওয়ান নর্থ ইস্ট’ সেই শূন্যতা পূরণ করবে।”অন্যদিকে প্রদ্যোত বিক্রম মাণিক্য দেববর্মন বলেন, “আমরা কোনও রাজনৈতিক দল ভাঙতে আসিনি, বরং মানুষকে একত্রিত করতে এসেছি।
এই অঞ্চলকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিতে হলে একসঙ্গে লড়াই করতে হবে।”যুব নেতৃত্বের উত্থান বিশ্লেষকদের মতে, এই নতুন রাজনৈতিক মঞ্চের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তরুণ নেতৃত্বের উপস্থিতি। চারজন নেতাই চল্লিশের কোঠায়, আধুনিক শিক্ষিত ও সামাজিকভাবে সক্রিয় প্রজন্মের প্রতিনিধি। তাঁরা বিশ্বাস করেন, রাজনীতিতে পরিবর্তনের সূচনা আসতে পারে নতুন চিন্তা, প্রযুক্তি ও উদ্যম থেকে।ম্হোনলুমো কিকন বলেন, “আমরা এমন একটি প্রজন্মের প্রতিনিধি যারা সংঘাত নয়, সমাধানের রাজনীতি চায়। আমাদের রাজ্যগুলোকে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, সহযোগী হিসেবে দেখতে হবে।”
সাংস্কৃতিক ঐক্য ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা‘ওয়ান নর্থ ইস্ট’-এর নেতারা তাঁদের ঘোষণায় স্পষ্ট করে বলেন, এটি কেবল রাজনৈতিক জোট নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পুনর্জাগরণের আন্দোলন।তাঁরা বিশ্বাস করেন, ভাষা, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস বা উৎসবের ভিন্নতা সত্ত্বেও উত্তর–পূর্ব ভারতের মানুষ একই ঐতিহ্যের অংশীদার।আগামী মাসেই গঠন করা হবে একটি “নর্থ ইস্ট ইয়ুথ কাউন্সিল”, যা তরুণদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে। এছাড়া শিক্ষা, পর্যটন, পরিবেশ সংরক্ষণ ও উদ্যোক্তা উন্নয়নের ওপরও বিশেষ জোর দেওয়া হবে।
জাতীয় রাজনীতির বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ‘ওয়ান নর্থ ইস্ট’-এর এই উদ্যোগ আগামী নির্বাচনী চিত্রে নতুন প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে যদি এই প্ল্যাটফর্ম সমগ্র আট রাজ্যে নিজেদের সংগঠন বিস্তৃত করতে পারে, তবে তা উত্তর–পূর্বে জাতীয় দলগুলোর আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাতে সক্ষম হবে।একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, “যদি এই ঐক্য টিকিয়ে রাখা যায়, তবে এটি হতে পারে ভারতের ফেডারেল রাজনীতিতে একটি মডেল — যেখানে আঞ্চলিক স্বার্থ, সাংবিধানিক কাঠামো ও উন্নয়ন একসঙ্গে কাজ করবে।”
বৈঠকের শেষে নেতারা একসঙ্গে ঘোষণা করেন, “আমরা প্রতিজ্ঞা করছি—একটি শক্তিশালী, সম্মানিত ও ঐক্যবদ্ধ উত্তর–পূর্ব ভারত গড়ে তুলব, যেখানে প্রতিটি নাগরিকের কণ্ঠস্বর শোনা যাবে।”এই ঘোষণার মধ্য দিয়েই শুরু হলো উত্তর–পূর্ব ভারতের এক নতুন রাজনৈতিক যাত্রা। ভবিষ্যতে ‘ওয়ান নর্থ ইস্ট’ কতটা প্রভাব ফেলতে পারে, তা সময়ই বলবে; তবে আপাতত এটি উত্তর–পূর্বের মানুষকে এক নতুন আশার দিগন্ত দেখিয়েছে।