
ত্রিপুরার সংস্কৃতির এক অনন্য দিক উন্মোচিত হলো সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী কের পূজা-য়। রাজপরিবারের ঐতিহ্য ও জনজাতি আচার-অনুষ্ঠান মিলিয়ে গড়ে ওঠা এই পূজার মূল উদ্দেশ্য—অশুভ শক্তির হাত থেকে মুক্তি ও শুভ ফলের প্রার্থনা।পূজার নির্দিষ্ট দিন ঘোষণা হতেই শুরু হয় প্রস্তুতি। ত্রিপুরা সরকারের দেবস্থান পরিচালন কমিটি পূজার যাবতীয় আয়োজন সম্পন্ন করে। পরদিন, রাজপরিবারের প্রতিনিধি ‘চন্তাই’ জিপগাড়িতে করে পূজাস্থলে পৌঁছান। তাঁকে দেয়া হয় আনুষ্ঠানিক স্বাগত, এবং তাঁর ও সহযোগীদের আতিথ্য গ্রহণের জন্য থাকে সরকারি বন্দোবস্ত।প্রচলিত রীতিমতো কামানের গোলার শব্দে পূজার সূচনা হয়, যা আশপাশের এলাকাবাসীকে পূজার শুরুবার্তা দেয়। চলে একাধিক ধর্মীয় আচার ও বিধিনিষেধ।পরদিন ভোরে, চন্তাই রাজকীয় পোশাকে পূজাস্থলে আসেন— মাথায় পাগড়ি, রঙিন ঝুল জামা, কোমরে বন্ধনী ও সোনালী তাগা। এই পোশাক নিজেই এক একটি প্রতীক। এরপর শোভাযাত্রা এগিয়ে যায় মানিক্য রাজবংশের সিংহাসনের দিকে, যেখানে ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে সম্মান জানানো হয়।পরে চন্তাই মানিক্য রাজবাড়ির মঙ্গলচণ্ডী মন্দিরে পূজা দেন এবং রওনা হন মূল পূজাস্থলের দিকে—একটি পূর্বপ্রস্তুত আয়তাকার খণ্ড জমি, যার চার কোণে স্থাপন করা হয় সবুজ বাঁশ। প্রতিটি বাঁশ ফুল ও চাঁদোয়ায় সুসজ্জিত। স্থানীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, এগুলো দেবতা ও পূর্বপুরুষের প্রতীক।পূর্ণ গম্ভীরতায় চন্তাই ও সহকারীরা এক রহস্যময় ভাষায় স্তোত্র পাঠ করেন, যা স্থানীয়দের মতে অশুভ শক্তি থেকে সুরক্ষা প্রদান করে। পূজার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পর্ব—চন্তাইয়ের হাতে বাঁশ ঘষে আগুন প্রজ্বালন এবং সেই ভস্মকে পূণ্যবস্তু হিসেবে ঘরে নিয়ে যাওয়া।ঐতিহ্যগতভাবে পশু ও পাখির বলি এই পূজার অপরিহার্য অঙ্গ। কেবল রাজপরিবারেই নয়, রাজ্যের গ্রামাঞ্চলেও এই পূজা পালিত হয়, বিশেষ করে ফসল রোপণের পরে। এর মাধ্যমে লোকাচার ও রাজাচারের এক বিরল সংমিশ্রণ গড়ে ওঠে।ত্রিপুরার সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ও আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের সাক্ষী এই কের পূজা, আজও সগৌরবে পালন করে যাচ্ছে রাজ্যবাসী।