
আচমকাই যেন বাজ ভাঙল ভারতীয় সঙ্গীতপ্রেমীদের হৃদয়ে। বলিউড থেকে আঞ্চলিক চলচ্চিত্র—সব জায়গায় সমান জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী জুবিন গর্গ আর নেই। সিঙ্গাপুরে স্কুবা ডাইভিং করতে গিয়ে মাত্র ৫২ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি। হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হলেও বাঁচানো যায়নি এই বহুমুখী প্রতিভাধর শিল্পীকে। তাঁর অকাল প্রয়াণে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে ভক্তকূল।
মৃত্যুর আগে কী ঘটেছিল?
ঘটনাটিকে ঘিরে নানা জল্পনা শুরু হয়েছিল। প্রথমে শোনা যায়, স্কুবা ডাইভিং করতে গিয়েই তিনি মারা গিয়েছেন। কিন্তু স্ত্রীর বক্তব্যে অন্য তথ্য উঠে এল।
গরিমা গর্গ, যিনি পেশায় ফ্যাশন ডিজাইনার, এক সংবাদমাধ্যমে বলেন,
“রবিবারই সিঙ্গাপুর থেকে ফেরার কথা ছিল ওর। কিন্তু আর ফেরা হল না। আমি ওকে হারালাম।”
গরিমা স্পষ্ট করে দেন, স্কুবা ডাইভিংয়ের সময় নয়, বরং তার পরে জুবিনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। তাঁর কথায়,
- স্কুবা ডাইভিংয়ে জুবিনের সঙ্গে ছিলেন আরও দু’জন—সিদ্ধার্থ ও শেখর।
- তাঁরা সবাই প্রথমে দ্বীপে ফিরে আসেন।
- এরপর জুবিন একাই আবার সমুদ্রের জলে নামেন সাঁতার কাটতে।
- সেখানেই হঠাৎ অচেতন অবস্থায় তাঁকে পাওয়া যায়।
গরিমা আরও জানান, বহু বছর ধরে মৃগীর রোগে (Epilepsy) ভুগছিলেন জুবিন। সমুদ্রের জলে সেই রোগের সমস্যাই ফের মাথাচাড়া দেয়। দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হলেও শেষমেশ তাঁকে আর বাঁচানো যায়নি।
১৯৭২ সালে মেঘালয়ের তুরা শহরে জন্ম হয় জুবিন গর্গের। শৈশবেই সঙ্গীতের পরিবেশে বড় হয়ে ওঠা। তিন বছর বয়সেই মা তাঁকে গান শেখানো শুরু করেন। এভাবেই শুরু হয় আজীবনের সুরযাত্রা।
১৯৯২ সালে তিনি পেশাদার গায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। প্রথমদিকে আসামি সিনেমার জন্য গান গেয়ে পরিচিতি পান। পরে ধীরে ধীরে বাংলা ও হিন্দি গানেও পা রাখেন।
বাংলা সিনেমার ভক্তরা তাঁকে ভুলতে পারবেন না। জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর জুটি অসংখ্য হিট গান উপহার দিয়েছে।
- মন মানে না ছবির গান আজও শ্রোতাদের মনে গেঁথে আছে।
- পিয়া রে গানও সাড়া ফেলেছিল তৎকালীন বাংলা গানের বাজারে।
তাঁর কণ্ঠে ছিল স্বতন্ত্র আবেগ, যা একদিকে মিষ্টি প্রেমের গানকে যেমন জনপ্রিয় করেছে, অন্যদিকে মঞ্চে এনে দিয়েছে অগ্নিময় উচ্ছ্বাস।
২০০৬ সালে ‘গ্যাংস্টার’ ছবিতে প্রীতমের সুরে জুবিন গেয়েছিলেন ইয়া আলি। এই গান গোটা দেশকে মাতিয়ে দিয়েছিল। হিন্দি সিনেমায় তাঁকে এক ধাক্কায় জাতীয় স্তরের পরিচিতি এনে দেয় এই গান।
এরপর তিনি একাধিক হিন্দি ছবিতে কণ্ঠ দিয়েছেন। তবে ইয়া আলি-এর জনপ্রিয়তা ছাপিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি।
শিল্পী জীবনের পাশাপাশি নানা বিতর্কেও জড়িয়ে পড়েছিলেন জুবিন গর্গ।
- মঞ্চে মদ্যপ অবস্থায় গান গাওয়ার অভিযোগে তাঁকে বহুবার সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল।
- তাঁর অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন ও নেশার অভ্যাস নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলেছিলেন অনেকে।
অনেকেই মনে করতেন, জুবিনের প্রতিভা হয়তো আরও উজ্জ্বলভাবে জ্বলে উঠতে পারত, যদি তিনি নিজের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারতেন।
হঠাৎ থেমে গেল সুর
সংগীতের এই যোদ্ধা তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনে বলিউড, টলিউড, আঞ্চলিক গান—সব জায়গায় ছাপ ফেলেছিলেন। কিন্তু ৫২ বছর বয়সেই জীবনের সুর থেমে গেল। তাঁর প্রয়াণে শোকস্তব্ধ সঙ্গীত জগত।
ভক্তদের মতে,
👉 “তিনি শুধু একজন গায়ক ছিলেন না, তিনি ছিলেন আবেগের প্রতীক।”
জুবিন গর্গের মৃত্যু আমাদের আরও একবার মনে করিয়ে দিল যে জীবন কতটা অনিশ্চিত। শরীরের সমস্যাকে অবহেলা করলে তা ভয়ঙ্কর পরিণতি ডেকে আনতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে মৃগীর অসুখে ভুগলেও তিনি সমুদ্রের জলে নামতে দ্বিধা করেননি। আর সেই সিদ্ধান্তই হয়তো তাঁর প্রাণ কেড়ে নিল।
আজ জুবিন নেই, কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া গানগুলো চিরকাল ভাসবে কোটি ভক্তের হৃদয়ে।
- মন মানে না কিংবা পিয়া রে আজও বাজলেই শ্রোতাদের মনে বিশেষ আবেগ জাগায়।
- আর ইয়া আলি তো এক প্রজন্মের কাছে ভালোবাসা ও বেদনার এক অনন্য প্রতীক।
জুবিন গর্গ শুধু একজন গায়ক ছিলেন না, তিনি ছিলেন আবেগ, স্মৃতি আর প্রজন্মের কণ্ঠস্বর। অকাল প্রয়াণে থেমে গেল তাঁর জীবনসুর, কিন্তু গান হয়ে তিনি বেঁচে থাকবেন কোটি ভক্তের হৃদয়ে। তাঁর জীবন আমাদের শেখায়—প্রতিভা যতই উজ্জ্বল হোক, স্বাস্থ্য ও সতর্কতা উপেক্ষা করলে তার পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। জীবন ফুরোয়, কিন্তু শিল্পী কখনও মরে না—তাই সুরের ভুবনে জুবিন গর্গ চিরঞ্জীব।